ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদের নাম বিয়ানীবাজার। প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানব সভ্যতার অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত এ অঞ্চলটি শুধু সিলেট নয়, গোটা বাংলাদেশের পর্যটনের সম্ভাবনাময় এক মহাসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। হাওর, বাওর, উঁচু-নিচু টিলা, কমলা-কাঁঠাল-আনারসের সুসজ্জিত বাগান, প্রাচীন মসজিদ-মন্দির, জমিদার বাড়ি, মাজারসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বিয়ানীবাজারকে দিয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
সিলেটের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত এই উপজেলাটি প্রাকৃতিক গ্যাস ও তৈলসম্পদে সমৃদ্ধ, যা দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর পর্যটন সম্ভাবনাও কোনো অংশে কম নয়। বিয়ানীবাজারের ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় স্থাপনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে দেশের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ
টেংরা রাজার দীঘি:
প্রাচীন টেঙ্গরা রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন বহনকারী এই দীঘিটি বড়দেশ ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামে অবস্থিত। একসময় টেঙ্গুরী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বাস করত, যারা গড়ে তোলে টেঙ্গরা বাজার। যদিও রাজবাড়ীর চিহ্ন মুছে গেছে, তবুও এই দীঘিটি সেই গৌরবময় অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীঘিটি পুনঃখনন ও সৌন্দর্যায়নের মাধ্যমে পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে।
বারপালের দীঘি:
পাল জমিদারদের স্মারক এই দীঘিটি খাসা দীঘির পাশে অবস্থিত। প্রাচীন কালে জমিদাররা এটি খনন করেছিলেন। বর্তমানে দীঘির ঘাটে বসে স্থানীয় জনগণ প্রতিদিন বিকেলে সময় কাটান। এটি পর্যটনের জন্য মনোরম স্থান হতে পারে যদি ঘাটগুলো সংস্কার, বেঞ্চ স্থাপন ও ডিঙ্গি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়।
বাসুদেব মন্দির:
সুপাতলা গ্রামের এই মন্দিরটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। প্রায় ১৫ শত বছরের পুরাতন এই মন্দিরের কষ্টিপাথরে নির্মিত বাসুদেব মূর্তি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। বার্ষিক মেলায় হাজারো ভক্ত জমায়েত হন। মন্দির সংরক্ষণ ও ঠাকুর দীঘির সৌন্দর্যায়ন পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
আঙ্গুরা পঞ্চখণ্ড পাকা জামে মসজিদ ও জায়গীরদার মসজিদ:
১৬৬২ সালে নির্মিত এই মসজিদ দুটি মুঘল স্থাপত্যের এক দৃষ্টান্ত। এই মসজিদ গুলো বিয়ানীবাজারের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা এবং পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
অনিপণ্ডিত লাইব্রেরী:
পন্ডিতপাড়া এলাকার অনিপণ্ডিত সংস্কৃত লাইব্রেরী একসময় বিয়ানীবাজারের বিদ্যাচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। এখন যদিও তা ধ্বংসাবশেষে পরিণত, তবুও ঐতিহাসিক মূল্য ও জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান হিসেবে এটি সংরক্ষণযোগ্য।
মুড়িয়া হাওর:
বিয়ানীবাজারের সবচেয়ে বিস্তৃত হাওর মুড়িয়া হাওর প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক অমলিন স্বর্গ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই হাওরটি অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবেও পরিচিত হতে পারে। একটি পরিকল্পিত জলোদ্যান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটি জাতীয় পর্যায়ের পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।
পাল রাজবাড়ি/ জমিদার বাড়ি:
পাল রাজবাড়ি/জমিদার বাড়ি পল রাজবংশের স্মৃতি বহনকারী বাড়িটি স্থাপত্য রীতিতে অনন্য। এটি সংস্কার ও সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি প্রামাণ্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
নানকার বিদ্রোহের স্মৃতি সৌধ:
১৯৪৯ সালের ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের স্মৃতিচিহ্ন এই সৌধ। সানেশ্বর উলুউরি গ্রামের সুনাই নদীর তীরে নির্মিত এই সৌধটি বাংলাদেশের প্রথম সফল সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের স্মারক। এখানে একটি সংরক্ষিত স্মৃতি উদ্যান গড়ে তোলা সম্ভব।
মাজারসমূহ:
গোলাবশাহ (র), সৈয়দ শাহ (র), আদিনা শাহ (র) সহ বহু অলিয়ার মাজার রয়েছে বিয়ানীবাজারে। এসব ধর্মীয় স্থান শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনুসন্ধানকারীদেরও আকর্ষণ করে।
ডাকবাংলো ও বধ্যভূমি:
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ঐতিহাসিক ডাকবাংলো ও শহীদ টিলা (রাধুটিলা) বিয়ানীবাজারের বুকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের সাক্ষ্য বহন করে। এখানে স্থাপিত স্মৃতি স্তম্ভ বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রতীক।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র
পঞ্চখণ্ড উচ্চ বিদ্যালয় ও বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ:
পবিত্র নাথ ও প্রমথ নাথ দাসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানদ্বয় ইতিহাস, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মূলে অবদান রেখেছে।
গোলাবিয়া লাইব্রেরি ও কালাচাঁদ মিলন মন্দির:
জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশে এ দুটি প্রতিষ্ঠান যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে কালাচাঁদ মিলন মন্দির বিয়ানীবাজারের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
জি.সি. দেব স্মৃতিস্তম্ভ:
শহীদ বুদ্ধিজীবী জি.সি. দেবের স্মরণে লাউতা গ্রামে স্থাপিত এই স্মৃতিস্তম্ভ ও ভবিষ্যতের জাদুঘর পর্যটকদের ইতিহাস চর্চায় আগ্রহী করবে।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা
জলঢুপ:
প্রকৃতির রানী খ্যাত জলঢুপের পাহাড়ি পথ, ফলের বাগান ও পাখির কলতান পর্যটকদের জন্য এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা।
গ্যাস ফিল্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদ:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তেলক্ষেত্র ও দুটি গ্যাসফিল্ড বিয়ানীবাজারকে অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ-দুই দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
বিয়ানীবাজারের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ পর্যটনের জন্য এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, সংস্কার ও সংরক্ষণের মাধ্যমে বিয়ানীবাজারকে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করা সম্ভব।