ছবি: সংগৃহীত।
বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ি বনাঞ্চলে একসময় হাতির চলাচল ছিল নিত্যচিত্র। কিন্তু গত কয়েক দশকে এ অঞ্চলের হাতির দল প্রায় হারিয়ে গেছে। এখন শুধু মৌলভীবাজারের পাথারিয়া বনে টিকে আছে তিনটি নারী হাতি। একমাত্র পুরুষ হাতিটি ২০১২ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে মারা যাওয়ার পর থেকেই বনটিতে হাতির প্রজনন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে পাথারিয়া বনে একটি পুরুষ হাতি ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বন বিভাগ। উদ্দেশ্য-হাতির প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং বিলুপ্তির আশঙ্কা থেকে প্রজাতিটিকে বাঁচানো।
হাতির সংকট ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান
বন বিভাগের তথ্যমতে, গত নয় বছরে দেশে মারা গেছে ১৪৮টি বন্য হাতি। অবকাঠামো উন্নয়ন, বনভূমি অধিগ্রহণ, অবৈধ দখল এবং কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন-সব মিলিয়ে হাতির আবাসস্থল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বাংলাদেশে এশীয় হাতিকে ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মাত্র ২৬৭টি বন্য হাতি টিকে আছে, যার বড় অংশ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটির পাহাড়ি বনে।
পাথারিয়ায় হাতি ছাড়ার পরিকল্পনা
হাতির প্রজননের সম্ভাবনা বাড়াতে বন বিভাগ গত ১৪ আগস্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিকে ২১ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও এখনো তা জমা পড়েনি।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী বলেন, ‘পাথারিয়া বনের তিনটি হাতি মূলত আধা গৃহপালিত। তাদের মালিক মারা গেলে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনা আছে সাফারি পার্ক থেকে একটি পুরুষ হাতি এনে এখানে ছাড়া হবে। তবে ছাড়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, হাতিরা একে অপরকে গ্রহণ করছে কি না এবং প্রজনন সম্ভব হচ্ছে কি না।’
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, ‘১৯৭৮ সালের দিকে পাথারিয়ায় ১৮টি হাতি ছিল। বিএসএফের গুলিতে একমাত্র পুরুষ হাতিটি মারা যাওয়ার পর বনে এখন শুধু তিনটি মাদী হাতি টিকে আছে। তবে এই হাতিগুলো বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে চলাচল করে। তাই এখানে পুরুষ হাতি ছাড়তে হলে ভারতের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি।’
সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপ’-এর বৈঠকে পাথারিয়ায় পুরুষ হাতি ছাড়ার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে শ্রীলঙ্কার বিশেষজ্ঞরা উদ্যোগটিকে স্বাগত জানান, তবে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা আপত্তি তোলেন।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্যোগের মূল্যায়ন
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেনজারড ওয়াইল্ডলাইফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সোহেল শ্যাম বলেন, ‘পুরুষ হাতি ছাড়ার উদ্যোগটি ইতিবাচক। তবে নারী হাতিরা নতুন পুরুষ হাতিকে কীভাবে গ্রহণ করবে, তাদের সামাজিক আচরণে কী পরিবর্তন আসবে, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন জরুরি। এসব প্রটোকল মানা না হলে নতুন সংঘাত বা বিপর্যয়ও ঘটতে পারে।’
বিশ্বব্যাপী কয়েকটি দেশে হাতির রিলোকেশন ও প্রজনন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও এর সাফল্য নির্ভর করে পরিবেশ, খাদ্য, সামাজিক অভিযোজন ও মানুষের সঙ্গে সংঘাত নিয়ন্ত্রণের উপর।
হাতি রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পুরুষ হাতি ছাড়লেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রজননের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল, পর্যাপ্ত খাবার, ও চলাচলের করিডর নিশ্চিত করা না গেলে এই উদ্যোগ টেকসই হবে না।
অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, ‘পুরুষ হাতি ছাড়া ইতিবাচক ফল মিললেও সেটি পর্যবেক্ষণ করতে হবে কমপক্ষে কয়েক বছর ধরে। নইলে হাতি আবার বন ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে।’
বাংলাদেশে হাতি রক্ষার উদ্যোগ হিসেবে পাথারিয়ায় পুরুষ হাতি ছাড়ার পরিকল্পনা একটি সাহসী পদক্ষেপ। তবে এটি সফল করতে হলে সীমান্ত সহযোগিতা, পরিবেশ সংরক্ষণ, এবং দীর্ঘমেয়াদি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। নচেৎ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই বন থেকে হাতির পদচিহ্ন একদিন পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে।