ফাইল ছবি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৯টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৪টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তিন নেতা এম এ মালিক, মোহাম্মদ কয়সর আহমেদ ও সওকত হোসেন।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন। তিনি জানান, বাকি পাঁচটি আসনের প্রার্থীও শিগগির ঘোষণা করা হবে।
প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ-১ আসনে আনিসুল হক, সুনামগঞ্জ-৩ আসনে মোহাম্মদ কয়সর আহমেদ, সুনামগঞ্জ-৫ আসনে কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন, সিলেট-১ আসনে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর লুনা, সিলেট-৩ আসনে এম এ মালিক, সিলেট-৬ আসনে এমরান আহমদ চৌধুরী, মৌলভীবাজার-১ আসনে নাসির উদ্দিন আহমেদ (মিঠু), মৌলভীবাজার-২ আসনে সওকত হোসেন (সকু), মৌলভীবাজার-৩ আসনে নাসের রহমান, মৌলভীবাজার-৪ আসনে মো. মজিবর রহমান চৌধুরী, হবিগঞ্জ-২ আসনে আবু মনসুর সাখাওয়াত হাসান (জীবন), হবিগঞ্জ-৩ আসনে জি কে গউস এবং হবিগঞ্জ-৪ আসনে এস এম ফয়সাল মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে সুনামগঞ্জ-২, সুনামগঞ্জ-৪, সিলেট-৪, সিলেট-৫ এবং হবিগঞ্জ-১ আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি।
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সিলেট-৩ আসনে মনোনীত এম এ মালিক যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, আর সুনামগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী মোহাম্মদ কয়সর আহমেদ যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। দুজনই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এছাড়া মৌলভীবাজার-২ আসনে প্রার্থী হওয়া সওকত হোসেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এবং কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য।
দলীয় সূত্রের তথ্যমতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ৫ আগস্ট এই প্রবাসী নেতারা দেশে ফিরে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সিলেট-৩ আসনের এম এ মালিক দীর্ঘ ১৯ বছর পর গত ১৭ অক্টোবর দেশে ফিরে নিজ এলাকায় অবস্থান করে একাধিক সভা-সমাবেশে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে নিয়মিতভাবে দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকেন। তাঁর অনুসারীদের ভাষ্যে, প্রবাসে থেকেও এম এ মালিক নিয়মিতভাবে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেও স্থানীয়ভাবে চিকিৎসাশিবির, শীতবস্ত্র বিতরণ ও খেলাধুলাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন তাঁর কর্মীরা।
তবে বিএনপির স্থানীয় একাধিক নেতার মতে, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে এম এ মালিক কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন। তাঁর প্রার্থিতায় দলীয় ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, “দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।”
দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান শেষে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন পাওয়া মোহাম্মদ কয়সর আহমেদ প্রায় এক যুগ পর দেশে ফিরে আবারও রাজনীতিতে যুক্ত হন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ওই এলাকায় বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী তেমন না থাকায় কয়সর সহজেই মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। সে কারণেই মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় তিনি শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন।
অন্যদিকে মৌলভীবাজার-২ আসনে সওকত হোসেনের প্রার্থিতা নিয়েও দলে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত সওকত কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি অনিয়মিতভাবে দেশে আসতেন, কিন্তু গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এলাকায় অবস্থান করছেন। সম্প্রতি কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হলেও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে তিনি মনোনয়ন পান।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের মতে, প্রবাসী নেতাদের প্রার্থিতা দলের আন্তর্জাতিক সংযোগ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সাংগঠনিক প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। যদিও স্থানীয় পর্যায়ে কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রার্থিতাকে ‘মাঠের বাস্তবতার সঙ্গে বেমানান’ বলে মন্তব্য করেছেন, তবুও দলীয় উচ্চপর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, প্রবাসে বিএনপির দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও প্রবাসী ভোটারদের প্রভাব বিবেচনায় এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেট অঞ্চল ঐতিহ্যগতভাবে প্রবাসনির্ভর—বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সিলেটিদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে প্রবাসী নেতাদের প্রার্থী করা বিএনপির জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় আর্থিক ও প্রভাবগত সুবিধা এনে দিতে পারে। অন্যদিকে স্থানীয় প্রার্থী প্রত্যাশীরা হতাশা প্রকাশ করলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছে, প্রবাসী প্রার্থীরা দলের নীতিগত বার্তা ও সাংগঠনিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করবেন।