হাবিবুর রহমান ও এম এ মালিক (ফাইল ছবি)
বিএনপিও যুক্তরাজ্য প্রবাসীকে দিল সিলেট -৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জের একাংশ) আসনের টিকেট। বিগত সময়ের আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও যুক্তরাজ্য প্রবাসীর উপরই নির্ভরতা রাখলো। একসময় এই আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও পরবর্তীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই বড় দলের প্রার্থী এ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক দুই নির্বাচনে এই আসনের মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের অবদানকে প্রায় পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের হাতে চলে গেছে।
চার বছর আগে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় নেতাদের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় প্রবাসী ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানকে। স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একেবারেই অপরিচিত মুখ। তখন এই পদক্ষেপটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা মনে করেছিলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে দলের কাজে নিয়োজিত থেকেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।
কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল ও ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেবার হাবিবুরের মনোনয়নটি নিশ্চিত হয়। সিলেট সিটির সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, শেখ রেহানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই আসনটি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাবিবুর রহমানকে উপহার দেন। বিনিময়ে তিনি নিজেকে নানা সুবিধা নিশ্চিত করতে সক্ষম হন বলে তখন অভিযোগ ছিলো।
এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ধারা এবার বিএনপিতেও প্রতিফলিত হলো। স্থানীয় নেতারা আশা করেছিলেন, দল তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও কাজকে সম্মান জানাবে। কিন্তু সেই আশা আবারও ভাঙল। স্থানীয়দের পাশ কাটিয়ে মনোনয়ন পেলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী এম এ মালিক। তিনি যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে তার অবদান চোখে পড়েনি।
জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ও জামায়াত শিবির দ্বারা নির্যাতিত নেতা আব্দুল আহাদ জামালসহ বহু স্থানীয় নেতাই মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তারা মনে করতেন, তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ এবং এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদের প্রার্থী করা উচিত। কিন্তু ভাগ্য তাদের সঙ্গে ছিলো না।
প্রায় একাধিক প্রবাসী প্রার্থী মনোনয়নের জন্য তৎপর ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্যারিস্টার সালাম, এম এ মালিক ফয়েজ উদ্দিন এম ই এবং আরও কয়েকজন। তবে শেষ হাসি হাসলেন এম এ মালিক।
স্থানীয় নেতাদের ত্যাগ, দীর্ঘদিনের শ্রম ও জনসংযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি যুক্তরাজ্য প্রবাসীর উপরই এ আসনটি ছেড়ে দিল। এর আগে আওয়ামী লীগের মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ও বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরী এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই দুজনও ছিলেন প্রবাসী। তবে তারা স্থানীয় রাজনীতিতে দির্ঘদিন থেকে ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন।
সিলেট-৩ আসনে প্রবাসীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়ে থাকে মূলত দুই কারণে; প্রথমত, তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক। দ্বিতীয়ত, দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের প্রভাবশালী অবস্থান। এ ধরনের প্রক্রিয়া স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে এবং দলীয় একতাকে দুর্বল করছে বলে তৃণমূলের নেতারা মনে করেন।
স্থানীয় নেতারা মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত হওয়ায় হতাশ। তাদের পরিচিত, দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা বাদ পড়ায় স্থানীয় জনগণ বঞ্চিত বোধ করছেন। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও ত্যাগী নেতাদের মতে, প্রবাসীদের মনোনয়ন দেওয়া হলে দলের নীতি ও সংহতি দুর্বল হয়। এছাড়াও, তারা বলছেন, প্রবাসী প্রার্থীরা অনেক সময় স্থানীয় জনগণের সমস্যা ও প্রয়োজনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন না।
অন্যদিকে, প্রবাসী প্রার্থীরা সাধারণত বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে আসেন, যা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সিলেট-৩ আসনে এই প্রবণতা প্রমাণ করেছে, যে স্থানীয় নেতৃত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ মনে করা হয় এবং প্রার্থীদের নির্বাচন কেন্দ্রীয় প্রভাব ও অর্থনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।
সিলেট-৩ আসনটির রাজনৈতিক ইতিহাস দেখায়, এক সময় জাতীয় পার্টির বেশ প্রভাব ছিলো। ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালে এবং ১৯৯৬ সালে এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হন। তাদের এমপি ছিলেন মুকিত খান। বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরী ১৯৯১ সালে এবং ২০০১ সালে ধানের শীষে এই আসন থেকে নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে এরপরের ৪টি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ এই আসন থেকে বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগের হয়ে এ আসনে প্রথম এমপি ছিলেন মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী কয়েস। পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হলেও তিনি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিল উত্থাপন করে আলোচনায় আসেন। এই মাহমুদুস সামাদ কয়েসও একসময় প্রবাসী ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি দেশে এসে ব্যবসা বাণিজ্য করে স্থায়ী হন। আর প্রবাসে স্থায়ী হননি।
২০২১ সালে মাহমুদুস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যু হলে এ আসনে উপনির্বাচনে স্থানীয়দের বাদ দিয়ে প্রবাসী নেতা হাবিবুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। যিনি একসময় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার প্রার্থী হতে চেয়েও মনোনয়ন বঞ্চিত হন।
সেই বিষয়টি স্থানীয় নেতাদের ক্ষুব্ধ করেছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী হওয়ার মতো সাহস কেউ দেখায়নি। প্রবাসী হাবিবুর রহমান যার স্থানীয় রাজনীতিতে ছিলেন একেবারেই অপরিচিত মুখ। কেবল আনোয়ারুজ্জামানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুযোগে শেখ রেহানার আনুকুল্যে তিনি দুবার মনোনয়ন পেয়ে যান। তখন থেকেই এই আসনটিতে স্থানীয়দের অবমূল্যায়নের রীতি শুরু হয়। স্থানীয় ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের শতাধিক নেতা এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধী ছিলেন।
রাজনৈতিক সমালোচকরা মনে করছেন, প্রবাসীদের মনোনয়ন দেয়া দলের নীতিগত দুর্বলতা প্রকাশ করে। স্থানীয় নেতৃত্বকে পাশ কাটানো হলে রাজনৈতিক দলগুলোর একতা ও জনমতের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে, এটি স্থানীয় নেতাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করতে পারে এবং দলের ভিতরে বিদ্রোহের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
সিলেট-৩ আসনের প্রবাসী প্রভাব রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে কী প্রভাব ফেলবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে স্থানীয় নেতৃত্বের প্রভাব আরও কমে যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সময় স্থানীয় নেতাদের গুরুত্ব দিতে হবে না হলে আসনের স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাতে স্থানীয় রাজনৈতিক কাঠামো ও নেতৃত্বের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে।
সিলেট-৩ আসন প্রমাণ করছে, যে বড় রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে প্রবাসীদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। স্থানীয় নেতারা যদিও দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও জনসংযোগকারী, তবুও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কৌশল প্রায়শই তাদের পথরোধ করে।
এই আসনে আওয়ামী লীগ এবং এবার বিএনপিও প্রবাসী প্রার্থীর দিকে ঝুঁকেছে। এর ফলে স্থানীয় নেতৃত্বের হতাশা, দলীয় সংহতির চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে, যা সিলেট-৩ আসনকে শুধু স্থানীয় নয়, বরং প্রবাসী প্রভাবের একটি উদাহরণ হিসেবেও পরিচিত করবে।