
ইএন রিপোর্ট: জ্যৈষ্ঠ্যের শেষপ্রান্তে এসে প্রকৃতি যেন চুপিসারে জানান দিচ্ছে বর্ষার আগমন। আকাশে জমে থাকা ঘন মেঘ আর টানা কয়েকদিনের নিঃশব্দ ভারী বৃষ্টি মিলিয়ে যেন মাটির বুক জুড়ে এক নরম আবেশ। ভারতের মেঘালয়ের গা বেয়ে নেমে আসা সেই জলধারায় ভরে উঠেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল—নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, প্রতিটি জলাধার যেন হেমন্তের ধানের মতো কানায় কানায় পূর্ণ।
এই জলছবির মধ্যে সবচেয়ে মোহময় রূপ ধারণ করেছে টাঙ্গুয়ার হাওর। মেঘালয়ের পাদদেশে শুয়ে থাকা এই জলজ রাজ্য এখন আয়নার মতো স্বচ্ছ জলে ঝলমল করে উঠছে। তাহিরপুর আর মধ্যনগর উপজেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর যেন বর্ষার ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠা এক কবিতা।
টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপ-রস-গন্ধ আজ শুধু বাংলাদেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরেও। জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ এই জলাভূমিকে ইউনেস্কো দিয়েছে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ সম্মাননা। আর জলাভূমি সংরক্ষণে রামসার চুক্তির আওতায় ১৯৯৯ সালে এটিকে ঘোষণা করা হয় দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট—সুন্দরবনের পরেই যার অবস্থান।
মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ত্রিশটিরও বেশি ঝর্ণাধারা এসে মিশেছে এই হাওরের বুকে। সেগুলোর মিলিত সুর যেন গায় এক অনন্ত বর্ষার গান। তাই অন্য সব জায়গায় বর্ষা কেবল একটি ঋতু হলেও টাঙ্গুয়ার হাওরে তা এক অবিরাম অনুভব, এক নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের প্রকাশ।
সন্ধ্যার আগে সোনালি রোদ যখন জলরাশির উপর পড়ে, তখন মনে হয়—জল নয়, যেন রুপার ক্যানভাসে আঁকা আকাশের প্রতিবিম্ব। হাওরের বুক জুড়ে দুলে ওঠে মৃদু ঢেউ, জলে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল আর করচগাছ মাথা উঁচু করে জানিয়ে দেয় প্রকৃতির অমোঘ মহিমা। সেই সঙ্গে ভেসে বেড়ায় শত প্রজাতির পাখি, তাদের ডানার ঝাপটায় জলে ওঠে এক অদ্ভুত মায়া।
এই সময়টাতে টাঙ্গুয়ার হাওর যেন শুধু একটি জলাভূমি নয়, বরং হয়ে ওঠে হৃদয়ের খুব কাছের এক কল্পলোক—যেখানে প্রকৃতি কথা বলে, জল হাসে, আর বাতাস বয়ে আনে এক গভীর প্রশান্তি।
বর্ষার আগমনী সুরে প্রকৃতি যখন সাজছে নতুন রূপে, তখন ঈদের লম্বা ছুটির হাতছানি যেন এনে দিয়েছে বাড়তি এক আনন্দের রঙ। আর সেই আনন্দ ভেসে চলেছে টাঙ্গুয়ার হাওরের শান্ত জলে। বিশাল জলরাশির বুক জুড়ে যেন অপেক্ষার ঢেউ—হাজারো পর্যটক আসছেন, হৃদয়ে ভরে নেওয়ার আশায় প্রকৃতির মায়াবী ছোঁয়া।
তাহিরপুর-মধ্যনগরের মাঝখানে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটনপ্রেমীদের কাছে শুধু একটি গন্তব্য নয়, বরং হয়ে উঠেছে এক রূপকথার ভ্রমণলোক। ঈদের ছুটি শুরু হবার আগেই শত শত ভ্রমণপিপাসু বুকিং করে রেখেছেন হাউসবোট কিংবা দেশীয় বোট। কান্ট্রি বোট হোক কিংবা বিলাসবহুল হাউসবোট—সবকিছুর মধ্যেই চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। নতুন রং, ঝকঝকে পর্দা, আরামদায়ক বিছানা, দেশি খাবারের সুগন্ধে বোটগুলো যেন রূপ নিয়েছে ভাসমান অতিথিশালায়।
এই সময়ে টাঙ্গুয়ার জলরাশিতে ভ্রমণ সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের। আর তাই ঈদের ছুটিতে এ হাওর যেন পর্যটকদের হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সুনামগঞ্জ শহর কিংবা নেত্রকোনার মধ্যনগর—দুই পথেই ছুটে আসছে মানুষ। নদীপথে বয়ে আসা হাওরের দৃশ্য দেখে মন যেন ছুঁয়ে যায় কোনো পুরোনো কবিতা।
হাউসবোটগুলো এখন আর কেবল যাতায়াতের বাহন নয়, বরং একেকটি জলময় স্বপ্নপুরী। ওপরে খোলা ছাদে বসে হাওরের অনন্ত নীলিমায় চোখ ডুবিয়ে দেওয়া যায়, আর নিচে—এসি-যুক্ত আধুনিক রুম, সংযুক্ত বাথরুম, দেশি খাবারের আয়োজনে যেন বাসাও হার মানে। হাঁসের মাংস, হাওরের মাছ, কুয়েল কিংবা খাসির সুস্বাদু রান্নায় মুখরিত হয় দুপুর ও রাত। আর চা-কফির উষ্ণতায় জমে ওঠে গল্প।
এই ছুটিতে জনপ্রতি চার থেকে ১২ হাজার টাকায় মিলছে দুই দিনের ভ্রমণপ্যাকেজ। যেখানে শুধু টাঙ্গুয়ার জলরাশি নয়, সঙ্গে থাকছে নিলাদ্রী লেক, শিমুল বাগান, বারেকের টিলা, যাদুকাটা নদী, লাকমাছড়ার মতো অপরূপ স্থানগুলো ঘোরার সুযোগ।
স্থানীয় নৌ-চালক থেকে হাউসবোটের বাবুর্চি—সবাই যেন নিজ নিজ ভূমিকা নিয়ে স্বপ্নের একজন কারিগর। তাদের চোখে মুখে আনন্দ, প্রস্তুতিতে উচ্ছ্বাস। নয় থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত প্রায় সব বোট আগেই বুকড হয়ে গেছে—এ যেন উৎসব আর ভালোবাসার এক মিলনমেলা।
টাঙ্গুয়ার হাওর তাই এবার আর শুধু একটি গন্তব্য নয়, বরং ঈদের ছুটির এক জলজ স্বপ্ন। যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও উৎসব—সব একাকার হয়ে ছড়িয়ে দেয় অফুরান আনন্দ।
ঈদের ছুটির বাঁশি বাজতেই জীবনের কোলাহল থেকে ছুটি নিয়ে মানুষ ছুটছে প্রকৃতির কোলে। আর সে প্রাকৃতিক আশ্রয় যেন এখন টাঙ্গুয়ার হাওরের উদার জলরাশি। জল, বাতাস, সূর্য আর স্নিগ্ধ সবুজের আলিঙ্গনে ভাসছে ৯০টি হাউসবোট, আর প্রতিটিতেই দুলছে স্বপ্ন আর অপেক্ষার তরঙ্গ।
সুনামগঞ্জ হাউসবোট ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত আকন্দ জানালেন এক আশাবাদের গল্প, আমাদের ৯০টি হাউসবোটের প্রায় সবকয়টির বুকিং শেষ। এবার সবার প্রস্তুতিই নিখুঁত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন অগ্নিনির্বাপক ও লাইফ জ্যাকেট, তেমনি পরিবেশ সংরক্ষণের দিকেও রয়েছে কড়া নজর। সমিতির মনিটরিং টিম থাকবে সক্রিয়। প্রশাসনেরও সহযোগিতা চেয়েছি আমরা।
এই আশ্বাসের সুরে যেন মিশে আছে সুনিশ্চিত এক ভ্রমণের আমন্ত্রণ। দেশীয় বোটগুলোও পিছিয়ে নেই। ১৫ থেকে ২০ জন ধারণক্ষমতার এসব নৌকায় ভেসে থাকা যায় দুইদিন এক রূপকথার দেশে। ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার প্যাকেজে খাওয়া-দাওয়া, রাত্রিযাপন, আর নিলাদ্রী, শিমুলবাগান, বারেকের টিলা, যাদুকাটা, ওয়াচ টাওয়ার, লাকমাছড়া—সবকিছুর টানে এই বোটগুলো যেন এখন হাওরের ভাসমান কবিতা।
কিন্তু নিরাপত্তা ছাড়া তো শান্তি অসম্পূর্ণ। তাই ভ্রমণপ্রেমীদের আশ্বস্ত করে তাহিরপুর ও মধ্যনগর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঈদের ছুটিতে টাঙ্গুয়ার ভিড় মাথায় রেখেই বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আনোয়ারপুর ও থানাঘাটে মোতায়েন থাকবে পুলিশ। হাওরে নৌ-পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ করবে টহল। মধ্যনগরের ঘাটগুলোতেও ঝুলবে মোবাইল নম্বরসহ নিরাপত্তার নির্দেশনা।
আরও এক আশার বাণী এল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানালেন, ‘টাঙ্গুয়ায় এখন ভ্রমণে কোনো সমস্যা নেই। বর্ষা শুরু, তবে পরিস্থিতি অনুকূলে। বন্যা বা বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত সবাইকে ভ্রমণ নীতিমালা মেনে চলার অনুরোধ করছি।
এই ঈদে তাই টাঙ্গুয়া শুধু একটি গন্তব্য নয়, বরং হয়ে উঠেছে এক ভালোবাসার জলভাসা উৎসব। সবকিছু মিলে—বোট, বাতাস, নদী, পাহাড়, নিরাপত্তা আর মানুষের হাসি—একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই জলস্বপ্ন।