
ছবি- সংগ্রহ
আশরাফুল ইসলাম।। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘সৃজনশীল শিক্ষা’ শব্দটি গত দেড় দশকে বহুল ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হলেও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তবচিত্র এক ভিন্ন ও হতাশাজনক বার্তা বহন করছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও অনুমোদনের শর্তাবলিতে পাঠাগার ও বিজ্ঞানাগার থাকা বাধ্যতামূলক করা হলেও বাস্তবে এসবের অস্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র কাগজেই সীমাবদ্ধ।
প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাক্কালে পাঠাগারে দুই থেকে তিন হাজার বই থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনুমোদনের পর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেই পাঠাগার আর খোলা রাখে না। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অনুমোদন পাওয়ার জন্য বই ধার করে এনে ‘দেখিয়ে’ দেয় পাঠাগারের অস্তিত্ব। অথচ পরবর্তীতে সেই বইগুলো আবার ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়, পাঠাগার রয়ে যায় খালি তাক কিংবা তালাবদ্ধ গুদামঘরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পাঠাগার কক্ষকে শ্রেণিকক্ষ বানিয়ে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের প্রধান কেন্দ্রটি তাদের কাছেই অচেনা থেকে যাচ্ছে।
শুধু পাঠাগার নয়, বিজ্ঞানাগার ও কম্পিউটার ল্যাবের অবস্থাও উদ্বেগজনক। একসময় শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগে বিজ্ঞানাগারের শর্ত থাকলেও বর্তমানে কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষণভিত্তিক বিষয় আবশ্যিক হওয়ায় বিজ্ঞানাগার ও আইটি ল্যাব থাকা জরুরি। তদুপরি, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়টি সব বিভাগের জন্য আবশ্যিক হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাস্তবে কখনো কম্পিউটার দেখেওনি। যেসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার আছে, সেগুলো খোলা হয় শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতনের পরিদর্শনের সময়।
এমনকি ব্যবহারিক ও মৌলিক শিক্ষার জন্য যে বিজ্ঞানাগার থাকা আবশ্যক, তা অধিকাংশ কলেজে নেই বললেই চলে। আবার কোথাও কোথাও থাকলেও অচল, অথবা দরজায় তালা ঝুলছে বছরের পর বছর। অথচ সেসব প্রতিষ্ঠান থেকেই নিয়মিতভাবে বিজ্ঞান বিভাগের শত শত শিক্ষার্থী পাস করছে- অবশ্যই অলৌকিকভাবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়াই কেবল লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে পাস করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে বাস্তবতা হচ্ছে- এই সৃজনশীলতার মাধ্যমগুলোই শিক্ষার্থীদের জন্য অপ্রাপ্য। পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব- যা শিক্ষার মানোন্নয়নের হাতিয়ার, সেগুলো পরিণত হয়েছে সৌন্দর্যবর্ধক অনুষঙ্গে কিংবা বন্ধ ঘরের রূপে। শহরের বাইরে, বিশেষ করে মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা পাঠাগার বিজ্ঞানাগার কিংবা আইটি ল্যাব শব্দগুলোর সঙ্গেই অপরিচিত।
প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শিক্ষার গুণগত মান আজ উপেক্ষিত। অধিক লাভের আশায় ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়ে শ্রেণিকক্ষে রূপান্তর করা হচ্ছে পাঠাগার ও পরীক্ষাগারকে। পাঠ্যসূচি অনুসরণ করেও শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থাকছে। ফলত, তারা কাগজে-কলমে পাশ করলেও জ্ঞানে ও দক্ষতায় পিছিয়ে থাকছে।
গত কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাসের হার বৃদ্ধি দেখে অনেকেই আনন্দিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- যখন শিক্ষার মৌলিক উপকরণগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অদৃশ্য, তখন সেই পাসের মান কতটা অর্থবহ? আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শতাধিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই বিজ্ঞান বিষয়ে কৃতকার্য হচ্ছে। কারণ, তারা শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করছে, অভিজ্ঞতা বা প্রয়োগশক্তির উন্নয়ন ঘটছে না।
শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে হলে পাঠাগার ও বিজ্ঞানাগারকে কেবল শর্ত নয়, বরং শিক্ষার ন্যূনতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নবায়ন, পাঠদান অনুমতি ও পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়নের সময় এসব উপকরণের বাস্তব উপস্থিতি ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সচেতনতাও প্রয়োজন। পাঠাগার ও পরীক্ষাগার ছাড়া যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠছে, তা এক অর্থহীন কাঠামো ছাড়া কিছুই নয়। তাই সময় এসেছে এই দাবি তোলার- জ্ঞানহীন পাস নয়, চাই প্রকৃত শিক্ষা।