প্রকাশিত : ০৩ জুলাই, ২০২৫ ০৯:০০ (মঙ্গলবার)
অবশেষে তারবিহীন বিদ্যুতের যুগে বিশ্ব!

ছবি- সংগ্রহ

উনবিংশ শতকের বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা একসময় কল্পনা করেছিলেন এমন এক পৃথিবীর, যেখানে তারের জঞ্জাল থাকবে না, আর বিদ্যুৎ ভেসে যাবে বাতাসে। সেই কল্পনা বহু বছর ধরে বিজ্ঞানের ইতিহাসে রয়ে গেছে স্বপ্ন হয়েই। তবে অবশেষে সেই স্বপ্নের দরজায় কড়া নাড়ল বাস্তব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডারপা’ (DARPA) সম্প্রতি এমন একটি প্রযুক্তি সফলভাবে প্রয়োগ করেছে, যা ৯ কিলোমিটার দূরে তারবিহীনভাবে বিদ্যুৎ পাঠাতে সক্ষম। এমন অর্জন শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, এটি এক নতুন যুগের সূচনা, বিশ্ব যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে তার প্রমাণ। প্রযুক্তির ভেতরের গল্প: কীভাবে কাজ করে? ডারপার এই পরীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছে তাদের POWER (Persistent Optical Wireless Energy Relay) প্রোগ্রামের অধীনে। এর মূল কার্যপ্রক্রিয়া অনেকটাই এমন: . বিদ্যুৎকে লেজারে রূপান্তর করা হয়—অর্থাৎ এক ধরনের শক্তিশালী আলোতে। . সেই লেজার বাতাসের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত দূরত্বে পাঠানো হয়। . লক্ষ্যস্থানে থাকা ফটোভোল্টেইক রিসিভার (একধরনের উন্নত সৌরকোষ) সেই আলোকে পুনরায় বিদ্যুতে রূপান্তর করে। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার সময় ৮.৬ কিলোমিটার দূরে ৮০০ ওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ পাঠাতে সক্ষম হয় ডারপা। শুধু তাই নয়—তারা সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি দূরবর্তী স্থানে পপকর্নও তৈরি করে এর ব্যবহারিক কার্যকারিতা দেখিয়েছে! এই আবিষ্কারের তাৎপর্য কোথায়? এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারলে এটি পরিবর্তন করে দিতে পারে: যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের ডিভাইসে বিদ্যুৎ সরবরাহের পদ্ধতি, মহাকাশযানে শক্তি সরবরাহের কৌশল, দুর্গম অঞ্চলে বা ভূমিকম্প-পরবর্তী এলাকায় জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের সুযোগ, স্মার্ট সিটি ও ৫জি প্রযুক্তির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের পথ। অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন, এটি ভবিষ্যতের গ্রিডবিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থার প্রথম ধাপ হতে পারে। নিরাপত্তা ঝুঁকি: তবে আশার পাশাপাশি আশঙ্কাও আছে। যদিও ডারপার এই সাফল্য উৎসাহব্যঞ্জক, কিন্তু এখনো এ প্রযুক্তি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। র‌য়ে‌ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। লেজার এক ধরনের উচ্চশক্তির আলো। ভুলভাবে যদি কোনো মানুষ, প্রাণী বা উড়ন্ত যান এই বিমের রাস্তায় চলে আসে, তবে ত্বক পুড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে অন্ধত্ব পর্যন্ত হতে পারে। আবহাওয়ার প্রভাব: কুয়াশা, বৃষ্টি বা ধুলাবালির কারণে বাতাসে চলাচলকারী লেজারের শক্তি হ্রাস পেতে পারে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। শক্তি হ্রাস ও দক্ষতা: বর্তমানে ফটোভোল্টেইক রিসিভার প্রযুক্তি এতটা দক্ষ নয় যে শতভাগ শক্তি ফিরে পাওয়া যায়। প্রচুর শক্তি বাতাসে হারিয়ে যায়। আইন ও নিয়ন্ত্রণের অভাব: বাতাসে বিদ্যুৎ চলাচলের মতো বিষয়গুলো এখনো আন্তর্জাতিক বা জাতীয় আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। ফলে ভবিষ্যতে এটি নিয়ন্ত্রণে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতের পথ: কোথায় যাচ্ছে এই প্রযুক্তি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ পরিবহণ ব্যবস্থায় এটি এক নতুন বিপ্লবের ইঙ্গিত। ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে, ড্রোন উড়তে উড়তেই চার্জ নিচ্ছে বাতাস থেকেই, দূরবর্তী দ্বীপে বা পাহাড়ে আর খুঁটি বসাতে হচ্ছে না। লেজার পয়েন্ট দিয়েই পৌঁছে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, মহাকাশ থেকে সৌরশক্তি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানো হচ্ছে আলো রূপে, যা পুনরায় বিদ্যুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই সবই এখন আর সায়েন্স ফিকশন নয়, বরং পরীক্ষিত বাস্তবতা। টেসলার স্বপ্নপূরণ? নিকোলা টেসলা ১৯০১ সালে নির্মাণ করেছিলেন 'ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার' যার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে তারবিহীনভাবে বিদ্যুৎ পাঠানো। সে সময় প্রযুক্তি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা ব্যর্থ হয়। আজ ডারপার গবেষণা যেন সেই শত বছরের পুরনো স্বপ্নের আধুনিক ও বাস্তব পুনর্জন্ম। যদিও টেসলা রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাঠানোর কথা ভেবেছিলেন, আর ডারপা লেজার ব্যবহার করছে। তবু উদ্দেশ্য একটাই: 'বাতাসে ভেসে যাক বিদ্যুৎ!'?' শেষ কথা এই মুহূর্তে এটি যদিও পরীক্ষামূলক ও সীমিত সক্ষমতার প্রযুক্তি, তবে ভবিষ্যতে এর উন্নয়ন হলে এটি হতে পারে বিদ্যুৎ পরিবহণের নতুন অধ্যায়। তারবিহীন ইন্টারনেট যেমন আমাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে, তেমনই তারবিহীন বিদ্যুৎও পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীর শক্তির মানচিত্র। তবে প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা যেন মানবিকতা, পরিবেশ ও নিরাপত্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোয়, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।