
এআই জেনারেটেড ছবি
বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ রক্তজনিত রোগে আক্রান্ত হন, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার অভাবে জটিলতা বা মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়। রক্ত রোগগুলো বহুমাত্রিক, কোনোটি বংশগত, কোনোটি সংক্রামক বা পরিবেশগত কারণে সৃষ্ট, আবার কোনোটি ক্যানসারসদৃশ মারাত্মক।
সাধারণত দেখা যায় যেসব রক্ত রোগ:
১. থ্যালাসেমিয়া:
বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েক হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়। এটি একটি বংশগত রক্তরোগ, যেখানে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে সুস্থ হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না। ফলে রোগীদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। এখনো দেশের অনেক এলাকায় এই রোগের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা নেই।
প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশে আনুমানিক ১ কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক (Carrier)।
প্রতি বছর প্রায় ৭,০০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্মায়।
ধরন: β-Thalassemia এবং HbE-বিটা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি।
ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল: উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য এলাকা এবং সিলেটর কিছু অঞ্চলে বেশি বাহক পাওয়া গেছে।
২. অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা):
বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা অত্যন্ত সাধারণ একটি সমস্যা। অপুষ্টি, কৃমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি এর পেছনে অন্যতম কারণ। এতে কর্মক্ষমতা ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪১% এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩৩% এনিমিয়ায় ভোগে।
এই তথ্য বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (BDHS) ২০১৭-১৮ থেকে পাওয়া গেছে।
মূল কারণ: আয়রনের ঘাটতি, অপুষ্টি, পরজীবী সংক্রমণ (যেমন: কৃমি), অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা।
৩. লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা ও মাল্টিপল মাইলোমা:
রক্ত ও লসিকাগ্রন্থির ক্যানসার যেমন অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (AML), অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (ALL), ক্রনিক লিউকেমিয়া, এমডিএস (MDS), এমপিএন (MPN) ও বিভিন্ন ধরনের লিম্ফোমা, লিউকেমিয়া দিনে দিনে বাড়ছে। এই রোগগুলো জীবনঘাতী হলেও সঠিক চিকিৎসা ও সময়মতো হেমাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হলে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীদের মধ্যে লিউকেমিয়া রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ক্যানসারের প্রায় ৮-১০%।
শিশুদের ক্যানসারের মধ্যে ALL (Acute Lymphoblastic Leukemia) সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৪০-৫০%)।
প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশে ক্যানসারের মধ্যে লিম্ফোমার হার প্রায় ৩-৫%।
নন-হজকিন লিম্ফোমার প্রাদুর্ভাব বেশি।
কিছু লিম্ফোমা Epstein-Barr Virus (EBV) বা HIV সংক্রমণের সাথেও সম্পর্কযুক্ত।
বয়স: প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।হাসপাতাল-ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী:
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য টারশিয়ারি সেন্টারে বছরে প্রায় ১,৫০০-২,০০০ নতুন লিউকেমিয়া রোগী শনাক্ত হয়।
প্রাদুর্ভাব:
সুনির্দিষ্ট জাতীয় তথ্য না থাকলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হেমাটোলজি বিভাগে ভর্তি হওয়া রক্ত ক্যানসারের রোগীদের মধ্যে প্রায় ১০–১৫% মাইলোমার রোগী।
বয়স: সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ: একটি ২০২১ সালের একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের গবেষণায় দেখা গেছে, হেমাটোলজি বিভাগে ভর্তি হওয়া মাল্টিপল মাইলোমা রোগীদের গড় বয়স ছিল ৫৫ বছর।
৪. ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া (ITP):
এটি এমন একটি রোগ যেখানে শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা রক্তের প্লেটলেট ধ্বংস করে ফেলে। ফলে হঠাৎ রক্তক্ষরণ, ব্রুইজিং দেখা দেয়। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই একে ভুলভাবে টাইফয়েড বা ভাইরাল ফিভার হিসেবে ধরে চিকিৎসা করা হয়।
৫. হেমোফিলিয়া:
এটি একটি বিরল বংশগত রক্তক্ষরণজনিত রোগ, যেখানে শরীরে ক্লটিং ফ্যাক্টর না থাকায় রক্তপাত বন্ধ হতে চায় না। চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং এখনও অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
প্রাদুর্ভাব:
হিমোফিলিয়া ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ (HFB) অনুযায়ী, দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১,২০০ জন।
তবে আনুমানিক প্রকৃত রোগীর সংখ্যা ৫,০০০-৬,০০০+, যাদের অনেকেই অনির্ণীত।
ধরন: হিমোফিলিয়া A (Factor VIII deficiency) সবচেয়ে বেশি।
কেন গুরুত্ব দেওয়া দরকার?
রক্ত রোগ সাধারণত বহিরঙ্গন লক্ষণ দেখায় না, ফলে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়। একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব, অন্যদিকে দক্ষ হেমাটোলজিস্ট ও চিকিৎসা সুবিধার সংকটও রয়েছে। অনেক রোগী শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে জটিল অবস্থায় চলে যান। পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন।
করণীয়:
সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যমে রক্ত রোগ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম: থ্যালাসেমিয়া বা হেমোফিলিয়ার মতো রোগের জন্য বিবাহপূর্ব স্ক্রিনিং চালু করা জরুরি।
রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বৃদ্ধি: মেডিকেল কলেজ পর্যায়ে হেমাটোলজি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ করতে হবে।
রোগীর সহায়তা কর্মসূচি: সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে বিনামূল্যে রক্তদান কর্মসূচি, ওষুধ সরবরাহ ও সাশ্রয়ী চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। নিয়মিত রক্ত রোগ বিষয়ক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন।
হেমাটোলজি সেন্টার: প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি বিশেষায়িত হেমাটোলজি সেন্টার স্থাপন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে রক্ত রোগ বিষয়ে সচেতনতা ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ এখন অত্যন্ত জরুরি। রক্ত আমাদের জীবনের মূল শক্তি। এই শক্তির রোগগুলোকে অবহেলা করলে জাতির ভবিষ্যৎ দুর্বল হবে, এ সত্য উপলব্ধি করে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক: ডাঃ আবু ইউসুফ মোঃ নাজিম
সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ,
নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট