প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট, ২০২৫ ১৪:০৭ (সোমবার)
বারকি ভাঙার ভার কিন্তু ‘সেরে সোয়া সের’!

হ্যামার দিয়ে ভাঙা হয় বারকি (বুধবারের ছবি- ইমজা নিউজ)

তীরে বাঁধা সারিবদ্ধ বারকি নৌকা। আদেশ করা মাত্র নৌকায় চড়ে বসল একজন। হাতে বড় একটি হাতুড়ি। একের পর এক হাতুড়িপেটা চলছিল। কোনোটি ভেঙে পড়ছিল, কোনোটি আবার ছিদ্র হয়ে পানি উঠছিল।

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে টাস্কফোর্সের অভিযানে বারকি না ডুবিয়ে এবার এভাবে হাতুড়িপেটা করে ভাঙা হয়েছে। বারকি ভাড়া নেওয়া শ্রমিকেরা তখন এ দৃশ্য দেখে ‘গরিবের পেটে লাথি’ বলে আহাজারি করছিলেন।

‘ইমজানিউজ’ ডিজিটালে বুধবার রাত থেকে একটি ভিডিও আপলোড হয়েছে। তাতে সাদামাটা করে আছে ‘বারকির কী দোষ!’ কথাটা বুকে বিঁধে। তারচেয়ে বেশি বিঁধে বারকির নিরন্ন শ্রমিকের কথা। মোশাররফ নামের লোকটি বলেছেন, ‘কিস্তির টাকা কেমনে দিমু?’

সিলেট জেলা প্রশাসন বুধবার (১৩ আগস্ট) জাফলংয়ে পাথর লুটপাট বন্ধে এ অভিযান চালিয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযানে বিজিবি, আনসার ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন। নৌপথে চলা এ অভিযানে পিয়াইন নদের তীরে বারকি নৌকা রাখা হয়। এরপর হাতুড়ি (হ্যামার) দিয়ে ভাঙা হয়। প্রায় ঘন্টাখানেক চলা এ অভিযানে অর্ধশতাধিক বারকি নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে বলে অভিযানসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। যোগাযোগ করলে উপজেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়, জেলা প্রশাসন থেকে এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করা হবে।  

বারকি শ্রমিকদের রোজগারের বাহন হাতুড়িপেটায় ধ্বংস করার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় ঘটনাটিকে নির্দয় বলে আখ্যায়িত করছেন অনেকেই। বারকি শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মোশাররফের মতো অনেকেই জানান, এর আগে ৩১ জুলাই দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের অভিযানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে পিয়াইন নদের জিরোপয়েন্ট, বল্লাঘাট ও নয়াবস্তি এলাকায় বালুবাহী ৩৫টি বারকি নৌকা ডুবানো হয়েছিল। ২৭ জুলাই খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি অভিযানে ৫০টি বারকি নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমন অভিযানের প্রতিবাদ করায় এবার জেলা প্রশাসন থেকে ভাঙার অভিযান পরিচালনা করা হয়। অথচ অভিযান চলাকালে বারকি নৌকার চারপাশে ইঞ্জিনচালিত ও স্টিলবডির নৌকা ছিল। সেগুলো আটক করা হয়নি, ভাঙাও হয়নি।

 অভিযান হলে কেবল সাধারণ শ্রমিকের বাহন বারকি ধ্বংস করা হয় দাবি করে মোশাররফ বলেন, ‘আমি কিস্তিতে টাকা দিয়া নাও আনছি। একেকখান বারকি নাওয়ে চার-পাঁচজন শ্রমিকের রুজির পথ থাকে। বারকি ভাইঙা গরিবের পেটে লাথি দিয়াই তারার সুখ! ’

‘বারকি’ সিলেট অঞ্চলে জলজীবিকার একটি ঐতিহ্যবাহী নৌকা। বালু ও পাথরমহালে হাতে বাওয়া নৌকাটির প্রচলন প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। স্থানীয় ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তনকালে জলপথে চুন পরিবহনে ব্যয়বহুল জাহাজের বিপরীতে হাতে বাওয়া নৌকার প্রচলন হয়। লম্বা আকৃতির এই নৌকাটি জন বারকি নামে ব্রিটিশ নৌ-কারিগর প্রথম তৈরি করেছিলেন বলে নাম পড়ে ‘বারকি’। বর্ষা মৌসুমে একটি বারকি নৌকায় অন্তত চারজন শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহ হয়। সিলেট ও সুনামগঞ্জের সীমান্ত নদ-নদী ও বালু-পাথরমহালে অন্তত ৫০ হাজার বারকি নৌকা চলাচল করে। 
দেখা গেছে এই জলমৌসুমে বারকির ওপর ক্রোধ মেটাতে একটি চক্র সক্রিয়। তারও কারণ আছে। বারকি যন্ত্রবিহীন। সস্তাশ্রম। যন্ত্রদানবেরা হেরে যায় বারকিশ্রমিকের কাছে। যেভাবে হেরে গিয়েছিল সেই বিশ্বখ্যা্ত মার্কিন লোকগাথার জন হেনরি-কাহিনি। 
অনুযোগ শোনা যায়, বিজিবি চোরাচালানবিরোধী অভিযানেও একই অবস্থা। বাহক বাদ দিয়ে বারকি জব্দ হয়। বারকি ভাঙা হয়। পুলিশও তাই করে। আরও প্রশাসন আরও বেপরোয়া। গত বছর কোম্পানীগঞ্জের এক ইউএনও ধলাই নদের বুকে বারকি ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। একটি ভিডিও ছিল বলে রক্ষে। বারকি ডুবিয়ে প্রত্যাহার লেটার পেয়েছিলেন তিনি। একই কাণ্ড ঘটে গোয়াইনঘাটেও। জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে বালুভর্তি ৩৫টি বারকি নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে টাস্কফোর্সের অভিযান করা ইউএন রতন কুমার অধিকারীকে বদলি করে আবার বসানো হয়েছে।

৩১ জুলাই বারকি ডুবাও অভিযানের চার দিনের মাথায় তাকে বদলি করা হয়েছিল। ৭ আগস্ট যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করে। সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউএনও বদলির আদেশ হয় ৫ আগস্ট। আদেশে তার পদায়ন করা নতুন কর্মস্থল মৌলভীবাজার সদর। বিভাগীয় কমিশনার স্বাক্ষরিত। বদলির বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় কমিশনার জানান, স্বাভাবিক বদলি। এভাবে জানানোর পরই ঘটে উল্টোটি। বদলি বধ। 

দপ্তরসংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক সূত্র বলেছে, বালু ও পাথরমহাল সুরক্ষায় দায়িত্ব পালনে আন্তরিক না হওয়ায় বদলি করা হয়েছিল। এর মধ্যে টাস্কফোর্সের অভিযান প্রত্যক্ষ করার বিষয়টিও পর্যবেক্ষণে রয়েছে। তিনি চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি গোয়াইনঘাটে যোগ দিয়েছিলেন। তার স্থলে নতুন ইউএনও নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেই নিযুক্তিও এখন বাদ।

বাদবিবাদের পেছনে কারণ নিশ্চয় আছে। সেই কারণ প্রশাসনের ফাইলচাপা নয়। চাপিয়ে দেওয়া হবে হয়তো। চাপে-অচাপে প্রশাসন চলছে এলোমেলো। আর এতেই হয়তো ছোট ছোট দুঃখগাথা বড় হচ্ছে। বারকি নামের প্রান্তিকজনের বাহনটির কথায় আবার ফিরি। বলছিলাম, ভাঙা হয়েছে বারকি, তার কিস্তির টাকার কথা বলেছেন মোশাররফ। কিস্তি মানে সুদের টাকা। এ টাকা না দিলে কী পরিণতি তা আর জানার চেষ্টার জন্য তড়পাতে হবে না। কিস্তি ও সুদ সুউচ্চে না বুঝিয়ে আমাদের প্রশাসনযন্ত্রের শেরশাহিদের কাছে আবদার রাখছি, বারকি ভাঙেন। হ্যামার চালান অথবা থামেন। তার আগে কিস্তির টাকাটা দেন। সেরের উপর সোয়া সের বলে একটি প্রবাদ আছে। এ প্রবাদে বিবাদ অবস্থা জারি হতে পারে। বারকি ভাঙার ভার কিন্তু সেরে সোয়া সের।

ভাঙা বারকি জোড়া লাগানো যাবে না। চলবেও না। বাকি থাকবে কেবল কিস্তি। এই কিস্তির জন্য খিস্তিখেউড় শুনতে হবে তাদের। এভাবে ভাঙতে থাকলে কী হবে? হবে বিরাট কিছু।

একটি চিত্রকল্প দিয়ে রাখি। এ রকমটি না-ও হতে পারে। আর হওয়ার সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের মধ্যেই আছে। যদি, শেরশাহিরা বারকি ভাঙতেই থাকেন, তাহলে ভাঙা বারকি সংখ্যা বাড়তে বাড়তে নিরেট বেকার হবে শ্রমিকেরা। তখন তাদের কেউ কেউ কিস্তির টাকার জন্য সীমান্তে পাহাড়-কামলার পথে হামলে পড়বেন। আবার বারকি-বিপ্লবও ঘটতে পারে। এ বিপ্লবে কোনো স্লোগান থাকে না! থাকে কেবল বৈঠা। 

উজ্জ্বল মেহেদী: সাংবাদিক ও ‘বারকি, জন বারকি’ গ্রন্থের লেখক