প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১১:১০ (বুধবার)
মালয়েশিয়ায় কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষায় নতুন অধ্যায়

ছবি: সংগৃহীত।

দীর্ঘ আলোচনার পর মালয়েশিয়ার দেওয়ান নেগারা (সিনেট) মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) বহুল আলোচিত গিগ ওয়ার্কার্স বিল ২০২৫ পাস করেছে। ১৮ জন সিনেটরের অংশগ্রহণে হওয়া এই বিতর্কে শেষ পর্যন্ত বিলটি গৃহীত হয়, যা ই-হেলিং ও পি-হেলিং খাতের কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মানবসম্পদমন্ত্রী স্টিভেন সিম বলেন, বিদ্যমান আইনের ঘাটতি কাটিয়ে এই বিল নতুন সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষ করে, স্বয়ংক্রিয় কর্তন ব্যবস্থার মাধ্যমে গিগ কর্মীদের আয়ের ১.২৫% সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে জমা হবে। উদাহরণ টেনে তিনি জানান, প্রতিটি অর্জিত ১ রিঙ্গিত থেকে মাত্র এক সেন কেটে নেওয়া হবে।

এখন থেকে প্রিপেইড মডেলের বদলে পোস্টপেইড মডেল চালু হবে। ফলে অগ্রিম অর্থ প্রদান ছাড়াই কর্মীরা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আসবেন। আগে বছরে এককালীন আরএম ১৫৭.২০ থেকে আরএম ৫৯২.৮০ পর্যন্ত গুনতে হতো।

মোট ১০ ভাগে বিভক্ত ১১২ ধারার এই বিলে চারটি বড় দিক উল্লেখযোগ্য-
১. গিগ কর্মীদের স্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ,
২. আয়ের নীতি ও কাজের পরিবেশ নির্ধারণে ত্রিপক্ষীয় কাউন্সিল গঠন,
৩. বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা,
৪. সামাজিক নিরাপত্তা কভারেজ নিশ্চিতকরণ।

ভিন্নমত ও প্রতিক্রিয়া

জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন (NUJ) বিলকে স্বাগত জানালেও, তারা সংসদীয় নির্বাচন কমিটি গঠনের দাবি করেছে যাতে এর বাস্তবায়ন আগে বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা যায়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তেহ আথিরা ইউসুফ জানান, বৈষম্য প্রতিরোধ ও অন্যায্য বরখাস্ত রোধের ধারা প্রশংসনীয় হলেও, কার্যকর হওয়ার আগে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

অন্যদিকে, মালয়েশিয়ান ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেসের (MTUC) সভাপতি হালিম মানসোর বিলের প্রতি সমর্থন দেন। যদিও সংগঠনের মহাসচিব কামারুল বাহারিন মানসোর এর আগে এ প্রস্তাবিত আইনের বিরোধিতা করেছিলেন।

প্রবাসী কর্মীদের অভিমত

এই আইন নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কুয়ালালামপুরে ই-হেলিং চালক ফেনীর আবদুল করিম বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য স্বস্তির খবর। দুর্ঘটনা বা অসুস্থ হলে আগে কোনো সুরক্ষা ছিল না, এখন অন্তত কিছুটা নিশ্চয়তা পাব।’

সেলাঙ্গরে পি-হেলিং ডেলিভারিতে কর্মরত যশোরের রাশেদুল ইসলাম জানান, ‘আমাদের আয় বেশি না, কিন্তু ১.২৫% কর্তন হলে ভবিষ্যতে তার সুফল মিলবে।’

তবে গোম্বাকের কুমিল্লার শহিদুল হক সংশয় প্রকাশ করেন,‘কোম্পানিগুলো অনেক সময় আয় থেকে বেশি কেটে নেয়। এই আইন ঠিকভাবে কার্যকর না হলে তা কর্মীদের ওপর বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।’

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন

অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফাহিম হোসেন মনে করেন,‘এই বিল শ্রমবাজারকে আরও আনুষ্ঠানিক করবে। সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় ও প্রবাসী উভয় কর্মী সুরক্ষিত হবেন এবং দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

শ্রমবাজার বিশ্লেষক ড. নূরাইজা ইউসুফের মতে,‘গিগ কর্মীরা এতদিন অনিশ্চয়তায় ছিলেন। এখন আয়ের সামান্য অংশ কর্তন হলেও তা মূলত দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষায় বিনিয়োগ।’

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন,‘বাংলাদেশি ও অন্যান্য প্রবাসীরা গিগ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এই আইন তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করলে কর্মীরা আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন, যা দুই দেশকেই উপকৃত করবে।’

সব মিলিয়ে বলা যায়, সিনেটে পাস হওয়া গিগ ওয়ার্কার্স বিল ২০২৫ মালয়েশিয়ার লাখো স্থানীয় ও প্রবাসী কর্মীর জন্য নতুন সুরক্ষার বলয় তৈরি করেছে। তবে বাস্তবে সুফল কর্মীদের হাতে পৌঁছাতে হলে কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা এবং কোম্পানিগুলোর সহযোগিতা নিশ্চিত করাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।