জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়নি, গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়েই প্রধান বিভেদ
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৪০
ছবি: সংগৃহীত। আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ফটোসেশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
অবশেষে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পাঁচ দিনব্যাপী পর্ব শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থেকেই গেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর অনড় অবস্থানের মুখে কমিশন জানিয়েছে-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সরকারকে চূড়ান্ত সুপারিশ পাঠানো হবে। কমিশনের আশা, ১৫ থেকে ১৭ অক্টোবরের মধ্যেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর সম্পন্ন হবে।
শেষ দিনের আলোচনা
বুধবার বিকেল তিনটায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শুরু হয় আলোচনার শেষ পর্ব, যা চলে রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত। বিটিভি নিউজে সরাসরি সম্প্রচারিত এ আলোচনায় অংশ নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
শেষ দিনে দলগুলো মূলত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে-বিএনপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের পক্ষে অবস্থান নেয়, আর জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। গণভোটের প্রশ্ন, ভিন্নমতের বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েও কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
বিএনপির অবস্থান
বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হোক। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা সময় ও অর্থের অপচয় হবে এবং এতে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
তিনি প্রস্তাব দেন, সরকার একটি প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি করে গণভোটের আইনি ভিত্তি তৈরি করতে পারে। গণভোটে জনগণ জুলাই সনদ অনুমোদন করলে তা পরবর্তী সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে।
বিএনপি আরও প্রস্তাব দেয়, জুলাই সনদে ভিন্নমতগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে, যাতে প্রতিটি দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব ভিন্নমতের প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ প্রস্তাব করেন, নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
দলের প্রতিনিধি শিশির মনির বলেন, গণভোটের আগে ‘বিশেষ সংবিধান আদেশ’ জারি করে জুলাই সনদ তাতে সংযুক্ত করতে হবে। এ আদেশের ভিত্তিতেই গণভোট আয়োজন করা উচিত।
একই অবস্থান নেয় এনসিপিও। দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট হতে হবে এবং একটি আদেশ জারি করে সংসদকে ‘দ্বৈত ভূমিকা’-অর্থাৎ সাধারণ ও গাঠনিক ক্ষমতা-দিতে হবে, যাতে সংস্কারগুলো সংবিধানে টেকসইভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
অন্যান্য প্রস্তাব ও আলোচনার আহ্বান
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বিএনপি ও জামায়াতকে আলাদাভাবে বৈঠকে বসে সমঝোতার আহ্বান জানান। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম ও গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি পরামর্শ দেন, কমিশনের বাইরেও দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ভিন্নমত কমানোর চেষ্টা করতে পারে।
তবে বিএনপির প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়া এখন ক্লোজড চ্যাপ্টার, এখন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেই মনোযোগী হওয়া উচিত।’
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আলোচনার শেষে বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁদের সুপারিশে বলা হয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ আদেশ জারি করতে হবে। ওই আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজন করা হবে। গণভোটে দুটি প্রশ্ন থাকবে-একটি ঐকমত্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে, অন্যটি ভিন্নমত থাকা বিষয়গুলো নিয়ে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ১৩তম জাতীয় সংসদ গঠন হবে। গণভোটে অনুমোদন পেলে জুলাই সনদে উল্লিখিত সংস্কারসমূহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কমিশনের পরবর্তী পদক্ষেপ
আলী রীয়াজ জানান, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত একত্র করে আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে একটি জবাবদিহিমূলক ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে। যেন আগামী প্রজন্ম তার সুফল ভোগ করতে পারে।’
রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনার লক্ষ্যে গত বছরের অক্টোবরে গঠিত হয় ছয়টি সংস্কার কমিশন-সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন কমিশন। ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো তাদের চূড়ান্ত প্রস্তাব দেয়, যার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে।
দুই দফায় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে জুলাই সনদের খসড়া তৈরি হয়। তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে মতৈক্য না হওয়ায় প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হয়েছে।
বর্তমানে ঐকমত্য কমিশন আশা করছে-১৫ থেকে ১৭ অক্টোবরের মধ্যেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন হবে।
