ছবি: সংগৃহীত।
অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ‘সেফ এক্সিট’ বা নিরাপদ প্রস্থানের পথ খুঁজছেন-এমন মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রাজনীতির মাঠে যে ঝড় তুলেছেন, তার প্রভাব এখনো অব্যাহত। খোদ উপদেষ্টারাই এ বিতর্কে রসদ জোগাচ্ছেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে নাহিদের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনাও করেছেন।
এনসিপি বলছে, উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট খুঁজছেন, সেই নামের তালিকা তাদের হাতে রয়েছে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে,‘কে কোন দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরাপদে সরে পড়তে চাইছেন, তা শিগগিরই জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।’
ইতোমধ্যে অন্তত পাঁচজন উপদেষ্টা নাহিদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। বিশেষ করে রিজওয়ানা হাসান নাহিদ ইসলামের কাছে তার বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
নাহিদের মন্তব্য ও বিতর্কের সূত্রপাত
গত ৪ অক্টোবর এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম বলেন,‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন, তারা নিজেদের ‘সেফ এক্সিট’-এর কথা ভাবছেন।’
তার এই বক্তব্য মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। মন্তব্য ও ছবি সম্বলিত ফটোকার্ড নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক।
এনসিপির দাবি: তালিকা তাদের হাতে
এনসিপি বলছে, উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট খুঁজছেন, সেই নামের তালিকা তাদের হাতে রয়েছে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে,‘কে কোন দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরাপদে সরে পড়তে চাইছেন, তা শিগগিরই জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।’
দলের নেতাদের মতে, নাহিদ ইসলামের বক্তব্য কোনো গুজব নয়; বরং বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন। তাদের ভাষায়, ‘যতই সময় যাচ্ছে, কয়েকজন উপদেষ্টার ভূমিকা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। তারা একটি রাজনৈতিক দলের অনুগত হয়ে উঠেছেন-যেন সেই দলই নিশ্চিতভাবে ক্ষমতায় ফিরবে।”
নাহিদের পক্ষে দলের অবস্থান
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন বলেন,
‘নাহিদ ইসলাম যা বলেছেন, তা নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। তিনি নিজেও উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন-ভেতর থেকে অনেকের ভূমিকা দেখেছেন। তার হাতে হয়তো সংশ্লিষ্টদের তালিকাও রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,‘আমরা বাইরে থেকে যা দেখছি, তা হতাশাজনক। অনেক উপদেষ্টার কোনো উদ্যোগই নেই। মনে হয় না তারা একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন।”
দলের ভেতরে ক্ষোভ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এনসিপি নেতা বলেন “কিছু দলীয় আনুগত্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। যদি ছাত্র নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে সরকার গঠিত হতো, আজকের পরিস্থিতি এমন হতো না।’
তার অভিযোগ, ‘শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যই শত শত তরুণ রাজপথে প্রাণ দিয়েছে-এটাই এখন হতাশার কারণ।’
মিডিয়া ও রাজনীতি নিয়ে এনসিপির ক্ষোভ
দলের মতে, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া মাফিয়া মিডিয়া নেটওয়ার্ক এখনো সক্রিয়। তারা সুযোগ পেলেই সরকারে থাকা দু’জন ছাত্র উপদেষ্টাকে লক্ষ্য করে সংবাদ ছড়ায়, অথচ দেশজুড়ে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির বিরুদ্ধে নীরব থাকে।’
এনসিপি নেতারা মনে করছেন, ‘২৪ জুলাইয়ের যোদ্ধারা’ পুরনো রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। তাদের দাবি, ‘তরুণ নেতৃত্বের হাত ধরে দেশে বড় পরিবর্তনের সুযোগ এসেছিল, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই পথ থেকে সরে গিয়ে পুরনো রাজনীতির দাসে পরিণত হচ্ছে।’
সারজিস আলমের প্রতিক্রিয়া
নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক এবং জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সারজিস আলম। তিনি বলেন,‘কিছু উপদেষ্টা এমন আচরণ করছেন যেন শুধু দায়সারা দায়িত্ব পালন করেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘এক্সিট’ নিতে চান। এই মনোভাব নিয়ে অভ্যুত্থান-পরবর্তী কোনো সরকার টিকতে পারে না।’
নাহিদ ইসলামের ‘সেফ এক্সিট’ মন্তব্য ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, তা এখন স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনৈতিক মহলে এই বিতর্ক আরও গভীর হচ্ছে-আর এনসিপি দাবি করছে, শিগগিরই তারা সংশ্লিষ্টদের নাম প্রকাশ করবে।
