জুলাই জাতীয় সনদে আজ স্বাক্ষর: অংশ নিচ্ছে না এনসিপি, বিএনপি ও জামায়াত যাবে
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৫৩
ছবি: সংগৃহীত।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক মতপার্থক্য বজায় রেখেই আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে গঠিত এই সনদে সই করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা এবং ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
তবে অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে না জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ফেসবুকে দেওয়া এক ঘোষণায় দলটি জানায়, আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা ছাড়া সনদে সই করা অর্থহীন হবে। একই সঙ্গে বাম ধারার চারটি দলও সই না করার ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আজকের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সই করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব জানিয়েছে।
সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, বিকেল ৪টা থেকে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শুরু হবে। শুরুতে জাতীয় সংগীত ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সহসভাপতি, স্বাগত বক্তব্য দেবেন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি ও কমিশনের সদস্যরা সনদে স্বাক্ষর করবেন।
সবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সনদে সই করবেন ও বক্তব্য রাখবেন। অনুষ্ঠানের আগে সনদ প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে।
অনুষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার অতিথি উপস্থিত থাকবেন, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতা, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার, বিশিষ্ট নাগরিক, আমলা, সাংবাদিক, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ থাকবেন।
প্রধান উপদেষ্টা দেশের সব টেলিভিশন ও অনলাইন গণমাধ্যমে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারের আহ্বান জানিয়েছেন।
সনদে যা থাকছে
জুলাই সনদে রয়েছে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব-
এর মধ্যে ৪৭টি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে, আর ৩৭টি বাস্তবায়ন সম্ভব আইন, বিধি বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।
মূল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা সীমিত করা
রাষ্ট্রপতির কিছু নিয়োগ ক্ষমতা বৃদ্ধি
একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা
একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী থাকা নিষিদ্ধ করা
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে সরকারি-বিরোধী দলসমন্বিত বাছাই কমিটি গঠন
কিছু সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তন
উচ্চকক্ষে আনুপাতিক (PR) পদ্ধতিতে নির্বাচন
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ
তবে এসব প্রস্তাবের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে, যা সনদে উল্লেখ করা হয়েছে।
মতপার্থক্য ও রাজনৈতিক অবস্থান
বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে, জুলাই সনদকে ভিত্তি করে প্রজ্ঞাপন ও অধ্যাদেশ জারি করে একইসঙ্গে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
তারা মনে করে, এতে আলাদা করে নতুন সংসদকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি চায় জুলাই সনদের ভিত্তিতে প্রথমে একটি বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করতে হবে।
বিএনপির প্রস্তাব অনুযায়ী, ভিন্নমত থাকা দলগুলো সনদের অঙ্গীকারনামায় নিজেদের মত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারবে এবং নির্বাচনে জয়ী হলে সেই মত অনুসারে সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সনদের অনেক দফায় বিভিন্ন দলের মতভিন্নতা আছে। আমরা কমিশনকে অনুরোধ করেছি এসব স্পষ্টভাবে সনদে প্রতিফলিত করতে। ইনশাআল্লাহ, আমরা সই করব।’
সংস্কারপ্রক্রিয়ার পটভূমি
রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে, যখন সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
এই কমিশনগুলো ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব জমা দেয়, এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার পর ৩১ জুলাই পর্যন্ত প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে ৮৪ দফা চূড়ান্ত করে কমিশন, যা এখন জুলাই জাতীয় সনদ নামে স্বাক্ষরের অপেক্ষায়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করেছেন, ‘সব দলই শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদে যোগ দেবে। আজ না হলেও, কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে (৩১ অক্টোবরের মধ্যে) যে কোনো দল স্বাক্ষর করতে পারবে।’
সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘সবচেয়ে বড় আয়োজন আসলে জুলাই সনদ নিজেই। এটি বাস্তবায়িত হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসবে।’
