নাটক- সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার
নাটক- মানুষের মন, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নৈতিক বোধে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ ২১:০৩

ছবি- প্রাচ্যনাট
মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম: নাটক- শুধু বিনোদনের এক মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নাটক যুগে যুগে সমাজের অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভাষা হয়ে উঠেছে। তাই নাটক আজকের সময়েও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
নাটক- প্রতিবাদের মঞ্চ: ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে দেশে গণতন্ত্র হরণ, বাকস্বাধীনতার দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অনিয়ম শুরু হয়। সেই সময় মঞ্চনাটক, পথনাটক ও পাপেট নাটকের মাধ্যমে নাট্যকর্মীরা এই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তারা নাটকের ভাষায় সমাজকে সচেতন করার কাজ করেন, সাহসী প্রতিবাদ জানান।
সে সময় বহুল প্রচারিত পথনাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আরণ্যক নাট্যদলের 'ইতিহাস কথা বলে', 'রক্তাক্ত প্রান্তর', 'মূর্খ লোকের মূর্খ কথা' প্রভৃতি। এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে সজাগ হয়ে উঠতে থাকে।
এছাড়াও, মমতাজউদদীন আহমদের 'কি চাহ শঙ্খচিল', 'সাতঘাটের কানাকড়ি' 'বিবাহ', 'স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা'; সৈয়দ শামসুল হক 'টিনের তলোয়ার', এবং মামুনুর রশীদের 'লাল জমিন' নাটকগুলো বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
নাটকের ইতিহাসে সমাজচেতনা: প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র কিংবা বাংলার জারি-সারি ও পালা সর্বত্রই দেখা যায় নাটকের মাধ্যমে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার প্রবণতা। আমাদের বাংলায় নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ধীরেন বসু, সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হক, মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, এবং মুনীর চৌধুরী প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব তাঁদের নাটকে সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির গভীর বার্তা তুলে ধরেছেন। নাটক শুধু সমাজের চিত্রই নয়, নাটক হয়ে উঠেছে শোষিত মানুষের মুখপত্র।
নাটক ও সামাজিক সচেতনতা: নাটক বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। এটি মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, বিগ্রহ-বিপ্লব, প্রাপ্তি-বঞ্চনা, সংগ্রাম-স্বপ্নকে মঞ্চে জীবন্ত করে তোলে। দারিদ্র্য, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, মৌলবাদ, শিক্ষার অবনতি কিংবা পরিবেশ দূষণ-এমন নানা সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন আমরা নাটকে দেখি। অনেক সময় যেসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন, সংবাদমাধ্যম বা পাঠ্যবই নীরব, নাটক সেই জায়গায় উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়।
নাটক মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়: নাটক কেবল বাস্তবতা তুলে ধরে না, সে বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেন এই বৈষম্য? কেন নারীরা বঞ্চিত? কেন গরিব বঞ্চিত হবে সুষ্ঠু চিকিৎসা বা শিক্ষার অধিকার থেকে? এইসব প্রশ্ন দর্শকের মনে জাগিয়ে তোলে নাটক। সেই প্রশ্নই ধীরে ধীরে চিন্তায় রূপ নেয়, চিন্তা রূপ নেয় প্রতিবাদে, আর প্রতিবাদ থেকেই আসে পরিবর্তন।
নাট্যচর্চা ও নতুন প্রজন্ম: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, থিয়েটার গ্রুপ, কমিউনিটি সেন্টার, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও নাট্যচর্চা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। নতুন প্রজন্মকে নাটকের মাধ্যমে সচেতন করে তুলতে হবে, যেন তারা সমাজের অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে অসঙ্গতিগুলোর প্রতিবাদ করতে শেখে শিল্পের ভাষায়। এটি কেবল পরিবর্তন আনার এক উপায় নয়, বরং একটি মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনের পথে অগ্রসর হওয়া।
শেষ কথা হলো, নাটক যেন কেবল মঞ্চে আটকে না থাকে। তা যেন মানুষের মন, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নৈতিক বোধে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আমাদের প্রয়োজন এমন নাটক, যা দেখার পর মানুষ আর আগের মতো থাকতে পারে না। যেন তাদের অন্তরে জেগে ওঠে প্রশ্ন, জেগে ওঠে দায়বদ্ধতা, জেগে ওঠে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। আজকের দিনেও নাটক কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং তা হতে পারে একটি সমাজবদলের শক্তিশালী মাধ্যম।
তাই আজকের সমাজে এই বার্তাটিই সবচেয়ে জরুরি- নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।