https://www.emjanews.com/

5481

opinion

প্রকাশিত

২০ মে ২০২৫ ২০:১৫

আপডেট

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:২৫

মতামত

চা–শ্রমিকদের রক্তে লেখা ইতিহাস ‘মুল্লুক চলো\'

আন্দোলনের ১০৪তম দিবস আজ

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫ ২০:১৫

ছবি- সংগ্রহ

ইএন রিপোর্ট: আজকের দিনে চা বাগানে প্রবেশ করলে যে নৈসর্গিক সবুজে মন বুঁদ হয়ে যায়, দুশো বছর আগেও কিন্তু এমন ছিল না। সোনালি স্বপ্ন দেখিয়ে একদল মানুষকে তৎকালীন আসামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এক অর্থে বন্দি করে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। রোগ, জরা আর হিংস্র ও বিষাক্ত সব প্রাণির ছোবল থেকে যে কজন মানুষ বেঁচে থাকতে পেরেছিল, তাদেরই প্রজন্ম আজকের বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা। তাদের রক্ত ঘাম আর বর্ণনাতীত ত্যাগে বিনিময়ে পাহাড়ি জঙ্গল হয়ে ওঠে অর্থকরি সবুজ বাগান।

চা পাতার সুবাস আর চা বাগানের অপরুপ সৌন্দযের আড়ালে লুকিয়ে আছে  এক নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘশ্বাস। চা–শিল্পের ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায় হলো ১৯২১ সালের ‘মুলুক চলো আন্দোলন’, যা ইতিহাসে ‘চরগোলা এক্সোডাস’ নামে খ্যাত। এই আন্দোলন চা–শ্রমিকদের নিজের ঘরে প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এবং বন্দিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত দলিল।

ইতিহাসের পটভূমি:

উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশরা বিহার, ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, ওডিশা, অন্ধ্র প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার শ্রমিককে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনে আসামের জনশূন্য দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে। তিন বছরের চুক্তিতে আনা হলেও তাঁদের বন্দি করে রাখা হয় বছরের পর বছর। খাদ্য, চিকিৎসা, ন্যায্য মজুরি—সবকিছুর অভাব ছিল প্রকট।

অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব:

১৯২০ সালে কংগ্রেস যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়, তখন চা–শ্রমিকদের মধ্যেও বিক্ষোভ জাগে। সিলেটের বিপিনচন্দ্র পালসহ কিছু কংগ্রেস কর্মীর গোপন কর্মকাণ্ডে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১–২ মে ১৯২১, চরগোলা ভ্যালির রাতারবাড়ি বাজারে বিশাল জনসভা হয়।

পদযাত্রার সূচনা:

৩ মে, আনিপুর চা–বাগানের ৭৫০ জন শ্রমিক পরিবারসহ কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েন স্বদেশের পথে। এরপর চরগোলা ও লঙ্গাই ভ্যালির ১৯টি চা–বাগান থেকে ৮,৭৯৯ জন শ্রমিক করিমগঞ্জের পথে যাত্রা করেন। এই অসাধারণ নিঃসরণের নামই হয় ‘মুলুক চলো আন্দোলন’—অর্থাৎ মুলুকে (নিজের দেশে) ফিরে যাও।

চাঁদপুরে ট্র্যাজেডি:

হাজার হাজার শ্রমিক চাঁদপুর রেলস্টেশনে জড়ো হন। খাদ্যসংকট দেখা দেয়। প্রথমে স্থানীয় প্রশাসনের সহানুভূতি থাকলেও, পরে ইউরোপীয় চা–বাগান মালিকদের চাপে আসে নিষ্ঠুরতা। ১৯ মে, সশস্ত্র হামলায় বহু নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মেঘনার জলে ভেসে যান। পরদিন আরও ভয়াবহ হামলা হয়। চাঁদপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম রঞ্জিত হয় রক্তে। আজ সেই স্টেশন আর নেই- ডুবে গেছে নদীগর্ভে।

রেল ধর্মঘট ও প্রতিক্রিয়া:

গান্ধীজী এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও, দেশপ্রেমিক নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত রেলশ্রমিকদের ডেকে তীব্র প্রতিবাদে নেমে পড়েন। আসাম–বেঙ্গল রেলে আড়াই মাসের ধর্মঘট পালিত হয়। এর ফলে ৪,৫০০ রেলকর্মী চাকরি হারান, চট্টগ্রামের রেল কোয়ার্টার খালি করে তাঁবুতে বাস শুরু হয়।

ইতিহাসে প্রভাব:

এই আন্দোলন একদিকে যেমন চা–শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিবাদ ও আত্মপরিচয়ের বোধ গড়ে তোলে, তেমনি অন্যদিকে উপমহাদেশের শ্রম–আন্দোলনের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হয়ে থাকে। আজও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের চা–বাগানগুলোতে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে সেই রক্তাক্ত বিদ্রোহের গৌরব গাঁথা হয়ে।

ঐতিহাসিক‘ মুল্লুক চল ’ দিবসকে  চা শ্রমিক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান ও এই আন্দোলনের ইতিহাসকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ক্দাত করার দাবি জানিয়েছে ‘চা শ্রমিক ঐক্য কেন্দ্রীয় কমিটি। এবছর ২০ মে কে তারা  চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করবেন।