
ছবি: সংগ্রহ
৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালার মাঠে নবী (সাঃ) পরিবারের সবাই যখন শাহাদাত বরণ করছেন এবং ইমাম হোসাইন (আঃ) কেবল একা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তাঁর পরিবার পরিজন এবং প্রতিপক্ষের সামনে গুরুত্বপূর্ণ এক বক্তব্য পেশ করেন, যা অনাগত ভবিষ্যতের জন্য একটি আদর্শ। তিনি জালিমদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন-
(ক) ‘তোমরা কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমি কি কোন পাপ অথবা অপরাধ করেছি?’ এজিদের সৈন্য বাহিনী নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল।
(খ) পুনরায় ইমাম হোসাইন (আঃ) বললেন, ‘আমাকে হত্যা করলে আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে? কি জবাব দেবে বিচার দিবসে মহানবী (সা.) এর কাছে?’ এজিদের সৈন্য বাহিনী দাঁড়িয়ে আছে।
(গ) আবার ইমাম হোসাইন (আঃ) বললেন, ‘আমাদের সাহায্য করার মত কি তোমাদের মাঝে একজনও নাই?'
(ঘ) তারপরের আহ্বানটি সাংঘাতিক মারাত্বক! ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হোসাইন (আঃ)-র শেষ আহ্বান। তিনি বলেন ‘আমার কথা কি শুনতে পাও না? তোমাদের মাঝে কি একটি মুসলমানও নাই?’
মুনাফেকের দল ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। কারবালা নিরব-নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
ইমাম হোসাইন (আঃ) এর এই প্রশ্নের মধ্যে যুগ-যুগান্তরের অনেক চিন্তার খোরাক লুকিয়ে আছে। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইয়াজিদ বাহিনীতে মুসলিম নামধারীরাই ছিল। তাদের দাঁড়ি ছিল, মাথায় টুপি ও পাগড়ী ছিল। তারা কারবালা প্রান্তরে জামাতের সহিত ফজর, জোহর ও আছর-এর নামাজ আদায় করেছিল। কিন্তু সেই দলে ন্যায় ও অন্যায়ের প্রভেদ করার মত কোন মানুষই ছিলো না, মুসলমান থাকাতো দূরের কথা।
কিন্তু অবাক করা এক ইতিহাস- ইমাম হোসেইন (আঃ)-এর সাথে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যোগ দেয়া এক অমুসলিম ব্রাহ্মণ পরিবার সেদিন ন্যায়ের পক্ষে অস্ত্র হাতে তুলেছিল। সেই পরিবারের একাধিক সন্তান ইমাম হোসেইন (আঃ)-এর জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন বলে লোকগাঁথা রয়েছে। সেই পরিবার বা গোষ্ঠীর লোকদের এখনো 'হুসেইনী ব্রাহ্মণ' বলা হয়। এই ব্রাহ্মণগোষ্ঠি এখনো ইমাম পরিবারের জন্য শোক প্রকাশ করে। শিয়া মুসলিমদের মত আশুরা উদযাপন করে। ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তানে এই পরিবারের সদস্যরা এখনো টিকে আছে। ভারতের পুনেতে প্রায় দুই শতাধিক হুসেইনী ব্রাহ্মণ পরিবার আছে। এই পরিবারের সন্তান ভারতীয় অভিনেতা সুনীল দত্ত ও সঞ্জয় দত্ত।
ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি হচ্ছে তৎকালীন পারস্যে (বর্তমান ইরাক) ইসলাম ধর্মের প্রচারক শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তাফা (সা:)- এর দৌহিত্র, শেরে খোদা মাওলা আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ) ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ (আঃ) পুত্র হযরত ইমাম হুসেন (আঃ)-এর পরিবার ও সহযোগীদের হত্যাকাণ্ড।
ইমাম হোসেইন (আঃ) পরিবারকে দশদিনব্যাপী অবরোধ করে অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ও ১০ মহররম ইমাম হোসাইন (আঃ) সহ অন্যদের হত্যা শুধু ইসলামের নয় বিশ্ব ইতিহাসের বর্বোরোচিত হত্যাকাণ্ড।
সেদিন ফোরাত নদী তীরের কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ছয় মাসের পুত্র হযরত আলী আছগর (রাঃ)-কে পানি পানকালে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। ইমাম হোসেইন (আঃ) সহ নবী পরিবারের ১৭ সদস্য ও আরো ৫৫ জন সঙ্গী মুসলমানকে ১০ই মুহররম নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
শুধু হত্যা নয় শহীদ ইমাম হোসেইন (আ;) ও শিশু আলী আছগর (রাঃ)-এর মস্তক মুবারকসহ অন্য ৭০ জন শহীদের মস্তক বর্শার আগায় বিদ্ধ করে দামেস্ক অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় নবী পরিবারের একমাত্র জীবিত পুরুষ অসুস্থ ইমাম জয়নাল আবেদিন (রাঃ) ও আহলে বায়াতের নারীরাসহ প্রায় ৪০ জনকে।
সেনাপতি সীমারের নির্দেশে ইমাম হোসেইন (আঃ) সহ অন্য শহীদানের লাশের ওপর ঘোড়া দাবিয়ে পবিত্র দেহগুলোকে দলিত-মথিত করে নরাধম এজিদ সেনারা। ওরা ইমাম শিবিরের তাঁবুগুলোতে আগুন দেয়, কান্নারত শিশুদের মারধর করে এবং নারীদের অলঙ্কার ছিনিয়ে নেয়, উট-ঘোড়া সহ সকল সামগ্রী লুট করে নেয়।
এমন এক অসম যুদ্ধে ভারতীয় ব্রাহ্মণ পরিবারের অংশগ্রহণ নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য জানা যায়। পরিবারটি ইসলাম ধর্মের অনুসারী না হয়েও নিজেদের নামের সাথে হুসেইন যুক্ত করে নেয়। যাদের নতুন পরিচয় হয় হুসেইনী ব্রাহ্মণ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরদের সমাজ নামকরণ করেছিল পীরালী ব্রাহ্মণ। ঐতিহাসিকভাবে এই 'পিরালী' (বা 'পীরালি') শব্দটি অপবাদমূলক ও নিন্দাসূচক অর্থদ্যোতক। নগেন্দ্রনাথ বসুর 'বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস' গ্রন্থের ব্রাহ্মণকাণ্ডের তৃতীয় ভাগে ব্যোমকেশ মুস্তফী 'পিরালী ব্রাহ্মণ বিবরণ' প্রথম খণ্ডে কুলাচার্য নীলমণি ভট্টের কারিকা অবলম্বনে পিরালী থাকের উৎপত্তির যে বিবরণটি দিয়েছেন তা নিম্নরূপ:
যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগণার গুড়-বংশীয় জমিদার দক্ষিণারঞ্জন রায়চৌধুরীর চার পুত্র কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেবের মধ্যে প্রথম দুই জন স্থানীয় শাসক মামুদ তাহির বা পীর আলির প্রভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। এর ফলে তাদের পুরো পরিবার, এমনকি যাঁরা ধর্মান্তরিত হননি তারাও সমাজচ্যুত হন। ব্যোমকেশ মুস্তফীর অনুমান, এই ঘটনা ঘটে পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী শুকদেবের কন্যাকে বিবাহ করে পিরালী থাকভুক্ত হয়েছিলেন। এই ব্রাহ্মণেরা পীরালী পরিচয় নিয়ে সমাজে নিন্দিত ছিলেন। তাই এই পরিচয় তাঁদের লুকাতে হতো। পীরালী ব্রাহ্মণদের মত হোসেইনী ব্রাম্মণদের নতুন নামকরণ সমাজে আড়াল করতে হয়নি। তাঁরা এই পরিচয় গর্বের সাথে প্রদান করে। শুধু পরিচয় প্রদান নয়, হুসেইনী ব্রাহ্মণেরা নিজেদের সন্তান জন্মের পরপর একটি ক্ষত চিহ্ন গলায় এঁকে দেয়- যা ইমাম হোসেইন (আঃ)-এর গলায় সীমারের ছুরি চালানোর ঘটনায় নিজেদের সহমর্মিতার চিহ্ন।
কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেইন (আঃ)-এর জন্য ছুটে আসা এই ব্রাহ্মণ যোদ্ধাদের নিয়ে হিন্দি-উর্দু ও পাঞ্জাবী ভাষায় অনেক লৌকিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে তাঁদের এভাবে ছুটে যাওয়ার পেছনের দুটি কাহিনী আছে।
প্রথমটি হচ্ছে, সিন্ধু উপত্যকার বর্তমান পাঞ্জাবের লাহোরের শিয়ালকোটের সাত জন সাহসী ব্রাহ্মণ তীরন্দাজ কারবালার যুদ্ধে ইমাম হুসেন (আ:)- এর পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
একটি বিবরণ অনুসারে, তাদের পিতা রাহাব দত্ত আরবদের সাথে পূর্ব থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। মরু আরবে একজন পয়গম্বরের আভির্ভাবের কথা জেনে তিনি সেই পয়গম্বরের সাক্ষাত-প্রত্যাশী হয়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। পথেই তিনি জানতে পারেন পয়গম্বর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। পয়গম্বরের প্রচারিত ধর্ম পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তিনি পারস্যের কুফা নগরীতে পয়গম্বরের সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। হিজরী ২০ সনে খলীফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তাঁকে কুফার কাজী পদে নিয়োগ দেন। ব্রাহ্মণ রাহাব দত্ত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) থেকে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। তিনি নিজের বংশধারা রক্ষা নিয়ে চিন্তিত। তিনি এই ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) জানান, হযরত ইয়ালা ইবনে মুররাহ (রা.) বর্ণিত হাদীসের বরাতে জেনেছেন- পয়গম্বর বলেছেন, ‘হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে। যে হোসাইনকে ভালবাসে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন। হোসাইন বংশসমূহের মধ্যে একটি বংশ’ (তিরমিজী)।
পয়গম্বরের দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের সাথে সন্তান প্রত্যাশী রাহাব দত্ত ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং সন্তান লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার ইচ্ছার প্রতিক্রিয়ায়, ইমাম হোসেইন (আঃ) তাকে জানান যে, তার ভাগ্যে কোন পুত্র সন্তান নেই। তিনি পুত্রের পিতা হতে পারবেন না, জানার পরে তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং কষ্টে কাঁদতে লাগলেন ও সন্তানের জন্যে পরম ঈশ্বরের কাছে ইমাম হোসেন'কে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেন। ইমাম হোসেইন প্রার্থণা করেন এবং তাকে জানান যে তার পুত্র সন্তান হবে।
ঘটনাচক্রে উপস্থিত জনৈক ব্যাক্তি হঠাৎ হুসেনকে প্রশ্ন করে যে, তিনি কেন এমন আশ্বাস দিচ্ছেন? এ কথা শুনে ইমাম হোসেইন দত্তকে বললেন, তার একটি নয়, একাধিক সন্তান হবে। ইমাম তাকে সাত সন্তান জন্মের সুসংবাদ দিয়ে ছিলেন। History of The Muhiyals:The militant Brahmin clan of India, T.P. Rusell Stracey (1911) -তে দেয়া তথ্যে এই সন্তানদের নাম পোরে, রাম সিং, হারাস রায়, রাই পুন, সাহস রায়, শের খান এবং ধারু।
কথিত আছে যে রাহব দত্ত যখন জানতে পারলেন যে শত্রুরা ইমাম হুসেন (আঃ) এবং তার পরিবারকে কারবালায় ঘিরে রেখেছে এবং নিরীহদের হত্যা করেছে তখন তিনি তাঁর সাত সন্তানকে কারবালা প্রান্তরে দ্রুত পৌঁছাতে বলেন। তাঁর সাত পুত্র কারবালা ময়দানে পৌঁছার পূর্বেই ইমাম হুসেন (আঃ)- এর প্রাণ হরণ করা হয়। ব্রাহ্মণেরা এজিদ বাহিনীকে তাড়া করে। ব্রাহ্মণ বাহিনী ও অন্যান্য মুসলিমরা ইয়াজিদের শাসনের ৪০ দিনের মাথায় তাকে উৎখাত করে।
ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর সেনাপতি আমির মুখতারের সঙ্গে ইয়াজিদের গভর্নর ওবায়দুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রাহ্মণেরা অংশ নেয়। সেই যুদ্ধে রাহিব দত্তের একাধিক পুত্রের মৃত্যু হয়। এজিদকে উৎখাতের পর আনন্দ মিছিল করে তারা। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে থাকে যে তারা ইমাম হুসাইনের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে।
যুদ্ধ শেষে রাহব দত্ত ইমাম পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করলেন এবং পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। হুসেনী ব্রাহ্মণ বলে দাবি করা বিপিন মোহন এর মতে, 'মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরিবারের সদস্যরা আমাদের পূর্বপুরুষ রাহাব সিং দত্তকে বলেছিলেন যে এখন থেকে আপনি কেবল ব্রাহ্মণ নন, হুসেনি ব্রাহ্মণ, আমরা আপনাকে স্মরণে রাখবো।'
আরেকটি ঘটনায় জানা যায়,ইমাম হুসাইনের স্ত্রী শাহর বানু আসলে চন্দ্রলেখার বোন ছিলেন। চন্দ্রলেখা আবার ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্তার স্ত্রী ছিলেন। ইমাম হুসাইন যখন জানতে পারেন যে ইয়াজিদ তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছেন তখন ভারতীয় এই রাজার সাহায্য চেয়ে একটি চিঠি লেখেন তিনি। চিঠি পেয়ে ইরাকে একটি বড় সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন চন্দ্রগুপ্তা। তবে সেই সেনাবাহিনী পৌছানোর আগেই ইমাম হুসাইনকে হত্যা করা হয়। তারা কুফা শহরে পৌছানোর পর (বর্তমান ইরাক) ইমাম হুসাইনের প্রতিনিধি মুখতার সাকাফি তাদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি ভারতীয় এই সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ এক স্থানে থাকার ব্যবস্থা করেন। এখনও সেই স্থানটি ‘দায়ের-ই-হিন্দিয়া’ নামে পরিচিত। যার অর্থ ভারতীয় কলোনি।
দত্ত ব্রাহ্মণদের কিছু যোদ্ধা ভুরইয়া দত্তের নেতৃত্বে মুখতার সাকফির সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারাই শুধু কুফায় থাকেন এবং বাকিরা ভারতে ফিরে যান। সেখানে তারা হুসাইনি ব্রাহ্মণ নামে নতুন এক সম্প্রদায় তৈরি করে।
এছাড়া হুসাইনি ব্রাহ্মণদের নিয়ে আরো কয়েকটি ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। আহমেদ পাঞ্জাবীর লেখা জিং নামা বইটির ১৭৫-১৭৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে শিয়ারা তাদের প্রতিদিনের দোয়ায় রাহাব দত্তের কথা উল্লেখ করেন। কারবালার ঘটনার সময় ১৪০০ হুসাইনি ব্রাহ্মণ বাগদাদে বাস করতো।
এছাড়া ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘কারবালা’ বইটিতেও দত্তদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুন্সি প্রেম চান্দ বলেন, কারবালায় যে হিন্দুরা মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলো তারা আশভাতামার উত্তরসূরী। এতে করে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরো স্পষ্ট হয়। কারণ দত্তরা আশভাতমাকে তাদের পূর্বসুরী বলে দাবি করে। রাহাবের একজন পূর্বসূরী সিধ বিয়োগ দত্ত আরবে তার বসতি গড়েন, এবং তিনি সুলতান উপাধিও পান। তিনি খুবই দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এবং মির সিদানী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্রহ্মার পুজা করতেন এবং সিধ জোজা’র ছেলে ছিলেন
পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় অনেক মহিয়াল ব্রাহ্মণ বাস করে। তবে একমাত্র ‘দত্ত’ বংশদেরকেই যোদ্ধা বলা হয়। বেশিরভাগ দত্তই হিন্দু ধর্মালম্বী হলেও কেউ কেউ অন্য ধর্মও পালন করে থাকে। মহিয়ালের ৭টি গোত্রের মধ্যে একটি হচ্ছে দত্ত।
হুসাইনি ব্রাহ্মণদেরকে মহিয়ালও বলা হয়ে থাকে। ইতিহাস মতে, শত শত বছর আগে তারা অনেক দূর থেকে পাঞ্জাবে যায়। তখন থেকেই তারা যোদ্ধা। অনেকে তো এখনও সেই পরম্পরা মেনে সেনাবাহিনীতে যোগদান করছেন। এই গোত্রেরই কর্নেল (অব.) রামসারুপ বকশী বলেন, নিজেকে হুসাইনি ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় সবাই অবাক হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি যে ফ্যাক্টরি চালাই, আমাদের গোত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার পর তারা খুবই অবাক হয় এবং চলে যায়।’ তবু ইমাম হুসাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পেরে গর্ববোধ করেন বলেই জানান তিনি।
তার মতে, এটি খুবই গর্বের বিষয় এবং এরজন্য হিন্দু ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু-মুসলিমের মাঝে শতবর্ষ পুরোনো বন্ধুত্বের স্বাক্ষর বহন করি।’
বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী নেত্রপ্রকাশ ভোগও একজন হুসাইনি ব্রাহ্মণ। তিনিও তার এই গোত্রের জন্য খুবই গর্বিত বলে জানান, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা ন্যায়বিচারের জন্য ইমাম হুসাইনের পক্ষে লড়েছেন। আমরা এখনও অন্তরে সেই ত্যাগকে লালন করি।’
পুনের মহিয়াল সমাজের প্রেসিডেন্ট জিতেন্দ্র মোহন বলেন, ‘আমরা আমাদের সামরিক রীতি চালু রেখেছি। আমরা প্রতিনিয়তই সেনাবাহিনীতে যোগদান করছি।’ তবে দেশভাগের পরে তাদের বেশিরভাগ ভারতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বিখ্যাত ভারতীয় সেলিব্রিটি সুনীল দত্ত এবং তাঁর ছেলে সঞ্জয় দত্ত হলেন হুসেনি ব্রাহ্মণ। শওকত খানুম ক্যান্সার হাসপাতালে অনুদান দেওয়ার সময় সুনীল দত্ত এই বাস্তবতা প্রকাশ করেছিলেন। হাসপাতালের সংরক্ষণাগার তাঁর নিম্নোক্ত শব্দের রেকর্ড বহাল রেখেছে: 'আমার প্রবীণদের মতো লাহোরের জন্যও আমি প্রতিটি ফোঁটা রক্ত ঝরিয়ে দেব যেভাবে আমার পূর্বপুরুষেরা ইমাম হুসেনের জন্য কারবালায় ঝরিয়েছিলেন।'
ইন্তিজার হুসেন হুসেনি ব্রাহ্মণদের উপর 'কারবালায় ব্রাহ্মণ' নামে একটি কলাম লিখেছেন যাতে তিনি ভারতের এক হুসেনী ব্রাহ্মণ মহিলার সাথে তার মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন যে তিনি প্রেম চাঁদের নাটক 'কারবালা' সম্পর্কে কথা বলার সময়, যে সাতটি হিন্দু ভাইয়ের কার্বালায় পৌঁছেছিলেন এবং ইমাম হুসেন (আ।) -এর পক্ষে লড়াই করেছেন তাদের কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল; তিনি যখন উল্লেখ করেছিলেন যে হুসেনি ব্রাহ্মণরা ভারতের সামাজিক দৃশ্য থেকে নিখোঁজ হয়েছে বলে মনে হয়; সব মিলিয়ে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দাবি করলেন যে তাঁর নাম নোনিকা দত্ত এবং তিনি হুসেনী ব্রাহ্মণ পরিবারভুক্ত।
নোনিকা দত্ত জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। ইন্তিজার হুসেন নোনিকা দত্তের সাথে তাঁর কথোপকথনটি ভাগ করেছিলেন যেখানে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ রাহাব দত্ত কীভাবে কারবালার যুদ্ধে তাঁর সাত পুত্রকে সমস্ত বলিদান করেছিলেন তা তুলে ধরেছিলেন। তিনিই যুদ্ধের একমাত্র বেঁচে যাওয়া যিনি কুফা থেকে আফগানিস্তান এবং সেখান থেকে ভারতে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সাথে ইমাম হুসেন (আ।)- এর একটি চুল নিয়ে এসেছিলেন যা কাশ্মীরের হযরতবাল মাজারে আবদ্ধ। তিনি হুসেনী ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় এবং আশ্চর্যজনক সত্য যোগ করেছেন; তিনি বলেছিলেন যে রাহব দত্তের প্রত্যক্ষ বংশধরেরা গলায় হালকা স্ল্যাশ চিহ্ন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, কারবালায় ইমাম হুসেন (আঃ) - এর জন্য তাদের ত্যাগের একধরনের প্রতীক। তিনি প্রতিটি সন্তানের জন্মের বিষয়ে তার পরিবারে যে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন তাও ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'ব্রাহ্মণদের মধ্যে, সন্তানের জন্মের পরের অনুষ্ঠানটি ইমাম হুসেন (আঃ)- এর নামে অনুষ্ঠিত হয়।'
কারবালা প্রান্তরে ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রখ্যাত শিয়া আলেম আল্লামা হাসান জাফর নকভি এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ব্রাহ্মণদের কারবালায় অংশগ্রহণের দাবিটি বৈধ। প্রচুর ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে যা কারবালার যুদ্ধে ব্রাহ্মণদের অংশগ্রহণকে সমর্থন করে।
ভারতের রাজস্থানের আজমীর, যেখানে হযরত খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি বসবাস করতেন এবং শেষকাল অতিবাহিত করেছিলেন, সেখানে আজও এমন একটি শ্রেণী রয়েছে যারা নিজেদেরকে হুসেনী ব্রাহ্মণ বলে ডাকে, যারা হিন্দু না এবং ধর্মীয় মুসলমান না। হুসাইন ব্রাহ্মণরা হিন্দুধর্ম ও ইসলামী ঐতিহ্যের মিশ্রণ অনুশীলন করে থাকে। হিন্দি/উর্দু ভাষাতে একটি জনপ্রিয় ভাষ্য হুসেনী ব্রাহ্মণকে বোঝায়: 'ওয়াহ দত্ত সুলতান, হিন্দু কা ধার্ম, মুসালমান কা ঈমান, আধা হিন্দু আধা মুসালমান (ভালো দত্ত সুলতান, হিন্দুর ধর্ম এবং মুসমানের বিশ্বাস, অর্ধ হিন্দু এবং অর্ধ মুসলমান)।
কারবালায় হুসেইনি ব্রাহ্মণদের অংশগ্রহণ বহুত্বে, বৈচিত্র্যে, ঐক্যে বিশ্বাসী এবং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে যারা ন্যায় ও সত্য রক্ষায় নির্ভিক থাকে তাঁদের জন্য অনুপ্রেরণার এক দূর্দান্ত উৎস।