https://www.emjanews.com/

8597

sylhet

প্রকাশিত

১৮ আগস্ট ২০২৫ ০০:৩৩

আপডেট

১৮ আগস্ট ২০২৫ ০০:৪৬

সিলেট

দিবস

নানকার কৃষক বিদ্রোহ: অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫ ০০:৩৩

ছবি: নানকার স্মৃতিসৌধ

১৮ আগস্ট ১৯৪৯- মানবসভ্যতার ইতিহাসে রচিত হয়েছিল এক নির্মম অধ্যায়। ব্রিটিশ আমলের ঘৃণ্য ‘নানকার’ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সেদিন ঝরে পড়ে পাঁচটি তাজা প্রাণ- ব্রজনাথ দাস (৫০), কটুমনি দাস (৪৭), প্রসন্ন কুমার দাস (৫০), পবিত্র কুমার দাস (৪৫) এবং অমূল্য কুমার দাস (১৭)। এর ১৫ দিন আগে জমিদারের লাঠিয়ালদের হাতে নিহত হয়েছিলেন রজনী দাস। শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়ে।
এই ছয়জন কৃষক বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করেছিলেন পূর্বসূরীদের ঋণ। রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে নানকার আন্দোলনের, আর তার ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালে সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে এবং নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানা স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
বাংলার অধিকারহীন মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাসে নানকার বিদ্রোহ এক গৌরবমণ্ডিত অধ্যায়।
নানকার প্রথা
উর্দু-ফার্সি শব্দ ‘নান’ এর বাংলা প্রতিশব্দ রুটি। রুটির বিনিময়ে যারা কাজ করতেন, তাদের বলা হতো নানকার। ব্রিটিশ আমলের সামন্তবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্ট শোষণপদ্ধতি ছিল এই নানকার প্রথা। নানকার প্রজারা জমিদারের দেওয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষিজমি ব্যবহার করলেও মালিকানা ছিল জমিদারের। এমনকি বাড়ির গাছের ফল খাওয়ার অধিকারও ছিল না তাঁদের।
নানকার প্রজাদের বিনা মজুরিতে জমিদারের বাড়িতে বেগার খাটতে হতো। সামান্য অপরাধে চলত অমানুষিক নির্যাতন। নানকার নারীরা ছিল জমিদারের ভোগের পণ্য। জমিদারের ডাকে যে কোনো সময় তাদের যেতে হতো জমিদার মহলে; প্রতিবাদ করলে পরিণাম হতো ভয়াবহ।
আন্দোলনের সূত্রপাত
কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের তথ্য মতে, সে সময় বৃহত্তর সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষের ১০ ভাগই ছিল নানকার। প্রথাটি মূলত বৃহত্তর সিলেট ও ভারতের করিমগঞ্জের নলুয়া, মেগন, বাগন ও ভগিচগি অঞ্চলে চালু ছিল। 
১৯২২ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ, ধর্মপাশা প্রভৃতি এলাকায় নানকার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
১৯২২ সালে বাহাদুরপুরের জমিদার রইস মিয়াকে যুতাপেটা করার মাধ্যমে জমিদারি অন্যায়ের প্রথম প্রতিবাদ করেন সাহসী ধূপি মথুরা। একই বছরে সুখাইড় অঞ্চলে এক নানকার নারীকে জমিদার মহলে তুলে নিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদে নানকার যুবকেরা তাকে উদ্ধার করেন। এরপর বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে সুনামগঞ্জের গৌরাঙ্গ ও বোয়ালজুর গ্রামে। এই বিদ্রোহের নেতা ব্রজবাসী দাসকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়।

১৯৩৭ সালে করিমগঞ্জ মহকুমার বিয়ানীবাজারে অনুষ্ঠিত সুরমা উপত্যকার প্রাদেশিক কৃষক সভায় প্রথম নানকার প্রথা বিলুপ্তির দাবি ওঠে। সভাপতি ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমদ। এরপর একে একে রফিনগর, রনকেলী, ভাদেশ্বর, বাহাদুরপুর, মহাকাল, কোণা সালেশ্বরসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
বিয়ানীবাজারের লাউতা-বাহাদুরপুর
ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার থানা। লাউতা ও বাহাদুরপুরের জমিদারেরা ছিলেন অমানবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। শোনা যায়, বাহাদুরপুর জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে বা ছাতা মাথায় চলা অপরাধ গণ্য হতো, এমনকি ঘোড়ায় চড়াও ছিল নিষিদ্ধ। এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদের সাহস কেউ করত না, কিন্তু ক্ষোভ জমতে থাকে অন্তরে।
ঐক্যবদ্ধ কৃষক-নানকার
ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টি নানকার ও কৃষকদের সংগঠিত করতে শুরু করে। অজয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শিশির ভট্টাচার্য, ললিত পাল, জোয়াদ উল্লাহ, আব্দুস সোবহান, শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ সক্রিয় ছিলেন। জমিদারের বিরুদ্ধে খাজনা বন্ধ, হদ-বেগারি বন্ধ, এমনকি জমিদারের বাজার বর্জন আন্দোলন শুরু হয়। এতে আতঙ্কিত জমিদারেরা পাকিস্তান সরকারের কাছে বিদ্রোহ দমনের আবেদন জানায়।
১৮ আগস্ট ১৯৪৯: রক্তাক্ত সকাল
১৭ আগস্ট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্রাবণী সংক্রান্তি। মনসা পূজার প্রস্তুতি শেষে সানেশ্বর ও উলুউরির মানুষ গভীর ঘুমে। ভোরে পুলিশ ও জমিদারের পেটোয়া বাহিনী গ্রামে হামলা চালায়। সানেশ্বরের মানুষ পালিয়ে উলুউরিতে আশ্রয় নিলে আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও সুরথ পালের নেতৃত্বে কৃষক-নারী-পুরুষ হাতে লাঠি, শলা, ঝাঁটা নিয়ে সুনাই নদীর তীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
কিন্তু ইপিআরের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে লাঠিসোটা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ব্রজনাথ দাস, কটুমনি দাস, প্রসন্ন কুমার দাস, পবিত্র কুমার দাস ও অমূল্য কুমার দাস।
 আহত হন হৃদয় রঞ্জন দাস, দীননাথ দাস, অদ্বৈত চরণ দাসসহ অনেকে। গ্রেফতার হন আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পালসহ বহুজন।
এই হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে উত্তাল হয়ে ওঠে আন্দোলন। প্রবল জনচাপের মুখে ১৯৫০ সালে সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে ও নানকার প্রথা রদ করে।

স্মৃতি ও চেতনা
১৯৯০ সালে নানকার শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সুনাই নদীর তীরে জমি ক্রয় ও স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও নানকার স্মৃতি রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, নুরুল ইসলাম নাহিদ।

 দীর্ঘদিন পরে, ২১ আগস্ট ২০০৯ সালে স্থানীয় ও প্রবাসীদের সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের উদ্যোগে স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন হয়। তখন থেকে প্রতিবছর নানকার দিবস পালন হচ্ছে অধিকার আদায়ের চেতনার প্রতীক হিসেবে।
আজ পালিত হচ্ছে নানকার কৃষক বিদ্রোহের ৭৬তম বার্ষিকী।
নানকার কৃষক বিদ্রোহ ,এক গৌরবগাথা, যা স্মরণ করিয়ে দেয় অধিকারহীন মানুষের সংগ্রামের অনিঃশেষ প্রেরণা।