
ছবি: সংগৃহিত।
২৩ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হয় দাস- বাণিজ্য বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস। এই দিবসটি ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়- দাসত্ব ও মানবপাচারের ভয়ঙ্কর বাস্তবতা স্মরণ করার পাশাপাশি আধুনিক সমাজে মানবাধিকারের গুরুত্ব ও সচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে পালন করা হয়।
দাসত্ব এক সময় সমাজের স্বাভাবিক অংশ ছিল। বিত্তশালীদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দাস থাকা স্বাভাবিক ধরা হতো, এমনকি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির পরিবারেও দাস ছিল। দাসকে সম্পূর্ণ মালিকের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। তারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করত, তাদের সন্তানও দাস হিসাবে বিবেচিত হতো এবং জীবনভর অমানবিক পরিশ্রম করতে হত।
কোম্পানিশাসিত বাংলাসহ সারা বিশ্বে দাস কেনাবেচার বাজার গড়ে উঠেছিল। আফ্রিকার মানুষদের জোরপূর্বক ধরে আনা হতো এবং ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বিক্রি করা হতো। দাসদের কৃষিকাজ, গৃহস্থালির কাজ এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির লালসা মেটানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে আটলান্টিকের মাধ্যমে দাস পরিবহন করা হতো ‘মিডল প্যাসেজ’ পথে, যেখানে অসংখ্য মানুষ মারা যেত।
বিশেষ করে দাস- বাণিজ্য ইতিহাসের সেই সময়কে নির্দেশ করে, যখন আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মানুষকে আটকিয়ে পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় বিক্রি করা হতো।
১৫০০ সালের দিকে শুরু হওয়া এই বাণিজ্যে অপহৃত নারী, পুরুষ ও শিশুকে বন্দী করে দূরের দেশে নেওয়া হতো। এ সময় দাসদের জীবনে কোনো অধিকার থাকত না, তাদেরকে জোরপূর্বক কৃষি, আখ বা কফি চাষে ব্যবহার করা হতো, এবং মধ্যপথে অসংখ্য মানুষ মারা যেত।
দাস প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম বড় আন্দোলন শুরু হয় ১৭৯১ সালের ২২ থেকে ২৩ আগস্ট সান্তো দোমিঙ্গোতে (আজকের হাইতি ও ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রে)। এই বিদ্রোহ দাস প্রথা বিলোপের পথে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দেয়। এর ফলস্বরূপ, ১৮০৭ সালে ব্রিটেনে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ হয়, রাশিয়ায় ১৮৬১ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ১৮৩৮ সালে দাসপ্রথা বন্ধ হয়। তবে মুক্তি পেলেও দাসরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি, বরং মালিকরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন।
আজকের দিনে দাসত্ব বা জোরপূর্বক শ্রম সম্পূর্ণ বেআইনি। যেকোনো ব্যক্তি যদি অন্যকে জোরপূর্বক আটকে রেখে কাজে বাধ্য করে, তাকে মানবাথিকার লঙ্গন হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অপরাধীরা আইনানুগ শাস্তির মুখোমুখি হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দেন, দাস- বাণিজ্য বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস শুধুই অতীতের ইতিহাস নয়, এটি নৈতিক দায়িত্বও- যে কেউ কখনো শোষণ বা মানবপাচারের শিকার হবে না, তা নিশ্চিত করার জন্য।
এই দিবসের মাধ্যমে দাস বাণিজ্যের শিকারদের স্মরণ করা হয় এবং মানবাধিকার, সমঅধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়।
দিবসটি প্রথমবার হাইতিতে ১৯৯৮ সালে উদযাপিত হয় এবং পরবর্তী বছর সেনেগালে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়। বর্তমানে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি দিবস।
তবুও আজও দাসত্ব বিদ্যমান- শরীরে কিংবা মননে। একটি জাতি কিংবা ব্যক্তি শারীরিকভাবে স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই অর্জিত হয়, যখন সে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়- দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন হওয়ার পরও মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচার, ভাবার এবং উচ্চারণ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থাকে বলা যায় স্বাধীন মানসিক দাসত্ব। তাই দাসত্বের প্রভাব শুধু বাহ্যিক নয়, মানসিকও।
আজকের বিশ্বে দাসত্ব প্রাচীনকালের মতো বৈধ নয়। তবে নব্য বা আধুনিক দাসত্ব এখনো একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। এটি মানবপাচার, জোরপূর্বক শ্রম, ঋণবন্দী শ্রম, শিশু শ্রম এবং যৌনপল্লী বা জোরপূর্বক বিয়ে, রাজনৈতিক কিংবা মানসিকভাবে প্রভাবিত হয়ে কিংবা প্ররোচনায় অথবা স্বেচ্ছায় প্রভৃতি নানা রূপে নানা রূপে বিদ্যমান।
দীর্ঘদিনের শাসন, নির্যাতন কিংবা আধিপত্য শুধু রাজনৈতিক কাঠামোকে নয়, ব্যক্তির মনন ও মানসিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, শাসিত মানুষের ওপর শাসকের প্রভাব শুধু রাষ্ট্রীয় দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তা গভীরভাবে প্রবেশ করেছিল মনোজগতে।
বাহ্যিক দাসত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২৭ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক দাসত্বের শিকার। এর মধ্যে শিশু ও নারী শ্রমিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ এই অপরাধের জন্য বেশি পরিচিত।
আধুনিক দাসত্ব নির্মূলের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের চুক্তি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রচেষ্টা, সামাজিক- সাংস্কৃতিক চর্চা, সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়াস।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধুনিক দাসত্ব রোধ করতে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি, আইনগত ব্যবস্থা এবং সামাজিক সচেতনতা একসাথে প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা এবং দাসত্বমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এখনো এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।