জগন্নাথপুরে রিংকনের মৃ.ত্যু দুর্ঘটনা নয়, শ্বাসরোধে খু.ন: পিবিআই
দুই আসামির আদালতে স্বীকারোক্তি: অথচ থানার দুই দফা চূড়ান্ত প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫ ১৫:৪৪

নিহত রিংকন বিশ্বাস
প্রায় এক বছর আগে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে একটি খামারে কর্মরত কিশোর রিংকন বিশ্বাসের মৃত্যু রহস্য উন্মোচন করেছে সিলেটের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রযুক্তির ব্যবহার করে এক বছর আগের ক্লু-লেস একটি হত্যাকান্ডের উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশের এই তদন্ত সংস্থা।
গ্রেফতারকৃত দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, রিংকন বিশ্বাসের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। উক্ত দুই আসামি ইতোমধ্যে আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। অথচ মৃত্যুর পর পরিবারের নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এটিকে ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করতে চাইলেও জগন্নাথপুর থানা মামলা নেয়নি। পরে নিহতের মা আদালতে হত্যা মামলা করলে তদন্ত শেষে আবারও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় জগন্নাথপুর থানা পুলিশ। এরপর বাদীর নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত পিবিআইকে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন।
ঘটনার পেছনের ঘটনা
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওরে লুলু মেম্বারের মাছের খামারে কাজ করতেন কিশোর রিংকন বিশ্বাস। ২০২৪ সালের ২২ জুন রহস্যজনকভাবে মারা যান তিনি। প্রভাবশালী লুলু মেম্বারের চাপে নিহতের পিতা শ্রীকান্ত বিশ্বাস বাধ্য হয়ে সামান্য মুখাগ্নি শেষে সেদিনই ছেলেকে সমাধিস্থ করেন।
ঘটনাটি জানাজানি হলে এবং বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় থানা পুলিশ নিহতের পিতার দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ২৪ জুন, ২০২৪ তারিখে একটি অপমৃত্যু মামলা রুজু করে। এরপর ২৭ জুন, ২০২৪ তারিখে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
ময়নাতদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশ জানায়, রিংকন গাছে উঠে আম পাড়তে গিয়ে পা ফসকে খামারের গোবরের ঢিবিতে পড়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে নিহতের মা বাসন্তী রানী বিশ্বাস মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশের এই প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট না হয়ে নিজেই বাদী হয়ে আদালতে লুলু মেম্বারসহ ১০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
আদালতের আদেশে জগন্নাথপুর থানার ওসি হত্যা মামলা রুজু করেন। কিন্তু তদন্ত শেষে পুলিশ আবারও আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে আবারও নারাজি দিলে আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য ২৩ মার্চ, ২০২৫ পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
পিবিআইয়ের তদন্ত ও আসামিদের স্বীকারোক্তি
পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ-উজ-জামানের নির্দেশনায় তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. তারিকুল ইসলাম তথ্যপ্রযুক্তি ও গোপন সোর্সের সহায়তায় চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত চিলাউরা গ্রামের মৃত সাইদুল্লাহর ছেলে জহিরুল ইসলাম (২৩) ও নুরুল হকের ছেলে পাবেল ওরফে তাবেল (২১)-কে ১৭ জুলাই গ্রেফতার করেন।
রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা রিংকনকে হত্যার কথা স্বীকার করে এবং অন্যান্য জড়িতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে। শনিবার (১৯ জুলাই) তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে তারা জানায়, ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে লুলু মেম্বারের খামারের গোয়ালঘরের পাশের আমগাছ থেকে রিংকনকে আম পাড়তে বলা হয়। গাছে বিদ্যুতের তার থাকায় রিংকন রাজি না হলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গোবরের ঢিবিতে মুখ ও মাথা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে বিষয়টিকে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
পুলিশ সুপারের বক্তব্য
পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ-উজ-জামান বলেন, 'ঘটনাটি এক বছরেরও বেশি আগের। প্রায় ৯ মাস পর আমরা তদন্তের দায়িত্ব পাই। কোনো ক্লু ছিল না, কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তদন্ত শুরু করি। ধরা পড়ে কিছু সন্দেহজনক কথাবার্তা, যা থেকেই আমরা মূল অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হই'।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।