
ছবি: সংগ্রহ
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো, রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া। এটি যেন এক নীরব ঘাতক, যা লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করলেও এর প্রভাব ভয়াবহ ও বহুমাত্রিক। বিশেষ করে নারী, শিশু, গর্ভবতী নারী ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্তদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। অথচ, কিছুটা সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসা হলে এনিমিয়া প্রতিরোধযোগ্য এবং নিরাময়যোগ্য একটি রোগ।
রক্তস্বল্পতা কী?
রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে তাকে বলা হয় রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া। হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরে অক্সিজেন পরিবহনের কাজ করে। এটি কমে গেলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অক্সিজেন সংকটে পড়ে এবং নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
লক্ষণসমূহ: রক্তস্বল্পতার উপসর্গ গুলো ধীরে ধীরে দেখা দিতে পারে।যেমন-
১. অতিরিক্ত দুর্বলতা ও ক্লান্তি
২. মাথা ঘোরা, বিশেষ করে দাঁড়ালে
৩. শ্বাসকষ্ট, সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে যাওয়া
৪. ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া
৫. হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া বা বুক ধড়ফড় করা
৬. ঠোঁট ও নখের নিচে রঙ ফ্যাকাসে হওয়া
৭. হাত-পায়ে ঠাণ্ডা অনুভব হওয়া
৮. মনোযোগে ঘাটতি, শিশুরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া
৯. গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত, সন্তান প্রসব জটিলতা
আমাদের দেশে প্রাদুর্ভাব:
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (BDHS) ২০১৭–১৮ অনুযায়ী:
১৫–৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৪১% এনিমিয়ায় আক্রান্ত।
৫ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩৩% রক্তস্বল্পতা রয়েছে।
গর্ভবতী নারীদের মধ্যে এই হার ৫০% এরও বেশি।
এনিমিয়া বাংলাদেশের নারীদের কর্মক্ষমতা, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য এবং শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
কারণসমূহ:
১. আয়রনের অভাব: সবচেয়ে বেশী প্রাদুর্ভাব (অপুষ্টি, ও অন্যান্য দীর্ঘ মেয়াদি অসুস্থতা)
২. ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12 এর ঘাটতি
৩. রক্তক্ষরণ: মেয়েদের অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, গর্ভকালীন রক্তপাত, পেপটিক আলসার, পাইলস।
৪. পরজীবী সংক্রমণ: যেমন কৃমি।
৫. দীর্ঘস্থায়ী রোগ: যেমন কিডনি রোগ, ক্যানসার, যক্ষ্মা।
৬. বংশগত রোগ: থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল ডিজিজ।
৭. ব্লাড ক্যান্সার (লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা, মাল্টিপল মাইলোমা, এমডিএস, এমপিএন)
৮. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস(RA) এসসএলই (SLE)
৯. লিভার, পাকস্থলী, ফুসফুস, কিডনি ও অন্ত্রের ক্যান্সার
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা:
১. সঠিক রোগ নির্ণয়:
পূর্ণ রক্ত পরীক্ষার (CBC) ও পিবিএফ (PBF) এর মাধ্যমে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ও রক্তের ধরন জানা যায়। একজন রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা এই পরীক্ষা করানো শ্রেয়।
প্রয়োজনে আয়রন প্রোফাইল, ভিটামিন B12/ফলিক অ্যাসিড পরিমাপ করা হয়।
২. কারণভিত্তিক চিকিৎসা:
আয়রন-ঘাটতিজনিত এনিমিয়া: আয়রন ট্যাবলেট বা ইনজেকশন, আয়রনসমৃদ্ধ খাদ্য।
ভিটামিনের অভাবজনিত এনিমিয়া: ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12 সাপ্লিমেন্ট।
রক্তক্ষরণজনিত এনিমিয়া: উৎস খুঁজে বন্ধ করা ও প্রয়োজনে রক্ত দেওয়া।
বংশগত এনিমিয়া (যেমন থ্যালাসেমিয়া): নিয়মিত রক্তদান ও কেলেশন থেরাপি।
৩. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন:
ক. খাবারে আয়রনযুক্ত খাদ্য যেমন কলিজা, ডিম, ডাল, পালং শাক, কলা, মাংস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা।
খ. ভিটামিন সি জাতীয় ফল (লেবু, আমলা, কমলা) খেলে আয়রনের শোষণ বাড়ে।
গ. চা/কফি খাবারের সাথে না খাওয়াই ভালো, এটি আয়রন শোষণ কমায়।
চিকিৎসা সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ:
১. বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এনিমিয়া চিকিৎসা উপলভ্য হলেও সমস্যাগুলো হলো:
২. প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের অভাব
৩. পুষ্টিহীনতা ও দারিদ্র
৪. পর্যাপ্ত আয়রন সাপ্লিমেন্ট কর্মসূচির ঘাটতি
৫. গর্ভবতী নারীদের রুটিন ফলো-আপে উদাসীনতা
৬. সঠিক সময়ে রোগীদের রেফার করা।
প্রতিরোধই উত্তম চিকিৎসা:
১. আয়রন ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট স্কুলভিত্তিক কর্মসূচিতে বিতরণ
২. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ
৩. গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
৪. পরামর্শ ব্যতীত নিয়মিত ওমিপ্রাজল ঔষধ সেবন
৫. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
পাঠকদের জন্য পরামর্শ:
যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, ফ্যাকাসে ভাব অনুভব করেন, তাহলে দয়া করে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করান। অল্প খরচে একটি পরীক্ষাই আপনাকে বড় জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।
রক্তস্বল্পতার জন্য রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ (হেমাটোলজিস্ট) এর পরামর্শ কেন প্রয়োজনীয়?
রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া একটি বহুমাত্রিক রোগ। অনেক সময় এটি শুধু আয়রনের ঘাটতি নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে জটিল রক্ত রোগ, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, অথবা মারাত্মক ক্যানসার। এজন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষ করে হেমাটোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ কেন জরুরি তা নিচে ব্যাখ্যা করা হলো:
সঠিক রোগ নির্ণয়: সাধারণ চিকিৎসায় শুধু হিমোগ্লোবিন মেপে আয়রন ট্যাবলেট দেওয়া হয়।
কিন্তু একজন হেমাটোলজিস্ট: হিমোগ্লোবিনের ও আরবিসি (RBC)) ধরন (MCV, MCH, RDW) বুঝে এনিমিয়ার ধরন চিহ্নিত করেন। বোন ম্যারো, আয়রন প্রোফাইল, ভিটামিন B12 ও ফলিক অ্যাসিড পরিমাপ করেন।
থ্যালাসেমিয়া বা অন্য বংশগত রক্তরোগ নির্ণয়ের জন্য হেমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস বা জেনেটিক টেস্ট সাজেস্ট করেন।
অনেক সময় রক্তস্বল্পতা হতে পারে নিচের রোগের উদাহরণ:
১. থ্যালাসেমিয়া
২. অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া
৩. হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া
৪. লিউকেমিয়া বা মাইলোমার শুরুতে
৫. ক্রনিক কিডনি ডিজিজে সেকেন্ডারি এনিমিয়া
৬. টিউবারকিউলোসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
এসব ক্ষেত্রে শুধু আয়রন নয়, ভিন্নধর্মী চিকিৎসা প্রয়োজন, যা একজন হেমাটোলজিস্ট দিতে পারেন।
অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে রক্ষা: অনেক সময় সঠিক কারণ না জেনে দীর্ঘদিন আয়রন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ানো হয়, যা লিভার ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এরকম অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর চিকিৎসা বন্ধ করতে হবে।
বিশেষ রোগীদের ব্যবস্থাপনা: গর্ভবতী নারী, ক্যানসার রোগী, ক্রনিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে হেমাটোলজিস্টের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি কার্যকর। তারা রোগী অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা দেন।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও ফলোআপ: হেমাটোলজিস্ট শুধু চিকিৎসাই দেন না, বরং রোগের প্রকৃতি বুঝে দীর্ঘমেয়াদি ফলোআপ, রক্তদান ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজন হলে ট্রান্সফিউশন, বা বোন ম্যারো টেস্টের মতো উন্নত সেবা সাজান।
সবশেষে বলা যায়, এনিমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য, নিরাময়যোগ্য রোগ হলেও এটি এখনো বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করছে। প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে কার্যকর স্ক্রিনিং, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের সচেতনতা, এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ।
রক্তস্বল্পতা শুধু একটি ব্যক্তির সমস্যা নয়, এটি জাতির শক্তির ওপর আঘাত। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যকে সচেতন করা।
রক্তস্বল্পতা যতটা সাধারণ মনে হয়, সব সময় তা ততটা সাধারণ নয়। সঠিক সময়ে একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় সফলতা নিশ্চিত করতে পারে এবং রোগীকে অনর্থক জটিলতা বা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
সতর্ক হোন, সচেতন হোন, রক্তস্বল্পতা হলে একজন হেমাটোলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
লেখক: ডা. আবু ইউসুফ মো. নাজিম
সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ,
নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট।