ছবি- সংগ্রহ
সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন, মনোনয়ন-সংক্রান্ত উত্তেজনা ও স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কোন্দল নিরসনের লক্ষ্যে আকস্মিকভাবে সিলেট সফরে এসেছেন বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ।
শনিবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনি বিমানযোগে সিলেটে এসে পৌঁছান।
বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদির আহমদ, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীসহ জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এ সফরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শুক্রবার রাতেই। সিলেট বিএনপির সাম্প্রতিক অস্থির পরিস্থিতি দলের হাইকমান্ডের নজরে এলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে জরুরি ভিত্তিতে সালাহউদ্দিন আহমদকে সিলেটে পাঠানো হয়। দলীয় একটি প্রভাবশালী সূত্র জানায়, মূলত সিলেটে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমন ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ফিরিয়ে আনাই তার এ সফরের মূল উদ্দেশ্য।
সূত্রটি আরও জানায়, আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই বিএনপি হাইকমান্ড সিলেট বিভাগের ১৯টি সংসদীয় আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। এই প্রক্রিয়ার আগে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় সব মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করাই এ সফরের অন্যতম লক্ষ্য। কারণ, একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা এবং পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
সিলেট জেলা বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. আকবর হোসেন জানান, ‘সালাহউদ্দিন আহমদের সফরটি সম্পূর্ণ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ। জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হওয়ায় আগে থেকে গণমাধ্যমকে জানানো সম্ভব হয়নি। আজকের সফরে কোনও গণসমাবেশ বা আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি নেই। তিনি জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং দলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবেন। এসময় তিনি জফলং সফরেও যাবেন তিনি। সেখানে তার গুম হওয়ার বিষয় নিয়ে কাজ চলমান একটি ডকুমেন্টারীতেও কথা বলবেন বলে জানা গেছে’।
অন্যদিকে, সিলেট বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো হাইকমান্ডকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হয় গত বৃহস্পতিবার সিলেট-২ আসনের বিশ্বনাথে সংঘর্ষের ঘটনা। ওইদিন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনার সমর্থক এবং তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবিরের অনুসারীদের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের অন্তত কয়েকজন আহত হন, এবং এলাকাজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনায় বিশ্বনাথ উপজেলা, পৌর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, বহিস্কৃতদের নিয়ে হুমায়ূন কবির সভা করেন। সভাশেষে বিশ্বনাথ সদরে তার সঙ্গে থাকা বহিষ্কৃত বিশ্বনাথের চিহ্নিত ও ফ্যাসিস্ট আমলে সুবিধাভোগী সুহেল চৌধুরী বিশ্বনাথ বাসিয়া ব্রিজে গাড়ী থেকে নেমেই ব্র্রীজে দাড়িয়ে থাকা সাধারণ জনতার উপর অর্তকিত হামলা চালায় এবং সঙ্গে থাকা সিলেট ও ছাতক থেকে আনা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা করে। সাধারন জনতার উপর এ ন্যাক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন এ ধরনের হামলা পূর্ব পরিকল্পিত এবং শান্ত বিশ্বনাথকে উত্তপ্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস।
এর আগে, গত মঙ্গলবার সিলেট-১ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীতা নিয়ে দলীয় অভ্যন্তরে নতুন উত্তেজনার জন্ম দেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এক কর্মী সভায় তিনি স্পষ্টভাবে জানান, তিনি নিজের অবস্থানে অনড় আছেন এবং মনোনয়ন না পেলে ‘কঠোর সিদ্ধান্ত’ নিতে পারেন। এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে জেলা-মহানগর বিএনপির ভেতরে আলোচনা ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। যদিও তিনি এই বক্তব্যটি কাটছাট করে প্রচার করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, এই দুই ঘটনার সমন্বিত প্রতিক্রিয়া হিসেবে সিলেট বিএনপির ভেতরে বিভক্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ লুনা-হুমায়ুন কবির পক্ষের, আবার কেউ বা আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষের অবস্থানে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আশঙ্কা করছে, মনোনয়ন ঘোষণার পর বিদ্রোহ ও বিভাজন দেখা দিতে পারে। ফলে এ পর্যায়ে একটি “নরম হাতের” হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন তারেক রহমান ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
দলীয় সূত্র অনুযায়ী, সালাহউদ্দিন আহমদ তার সফরে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি, মাঠ পর্যায়ের সাংগঠনিক অবস্থা, প্রার্থী-সমর্থক সম্পর্ক এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করতে একাধিক বৈঠক করবেন। তিনি আজ বিকেল থেকে সিলেট সার্কিট হাউসে অবস্থান করবেন এবং রাতের মধ্যে একাধিক বৈঠক শেষে শনিবার ঢাকায় ফিরবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে বিএনপির নিকটস্থ একটি সূত্র জানায়, তারেক রহমান সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক অনলাইন বৈঠকে সিলেটকে “সংগঠনিকভাবে অগ্রাধিকারের অঞ্চল” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, “সিলেট বিএনপির ঐতিহ্যগত শক্তি ধরে রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ বিভাজন এখনই ঠেকাতে হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাতে সিলেটের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধরে রাখা আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সিলেট অঞ্চলের চারটি জেলায় মোট ১৯টি আসনের মধ্যে অন্তত ১০টি আসনে বিএনপির ঐতিহ্যগত প্রভাব রয়েছে। এ অঞ্চলে দলীয় বিদ্রোহ হলে কেবল স্থানীয় নয়, জাতীয় পর্যায়েও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সিলেট বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, “দল এখন নির্বাচনমুখী। প্রার্থী চূড়ান্ত হলে সবাইকে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমদের সফরকে আমরা সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই দেখছি।”
দলের জেলা ও মহানগর নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় সালাহউদ্দিন আহমদ আজ দিনভর সিলেটে অবস্থান করবেন। এ সফরের শেষে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা গেছে।
