
ছবি: সংগৃহিত।
সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর লুটপাট নিয়ে গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। প্রশাসনের ব্যর্থতায় কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট হয়ে গেলেও সেই ব্যর্থতার দায় যাদের ঘাড়ে, তাদেরই আবার তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারকে, যার দায়িত্বকালেই ভয়াবহ লুটপাট আরও বেড়ে যায়। এ নিয়েই এখন সোচ্চার পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, ‘অভিযুক্তকেই যদি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে সত্য কখনো বের হবে না।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই ভয়াবহ লুটপাটের শিকার হতে থাকে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা ও সংলগ্ন রেলওয়ে বাঙ্কার। প্রথমে রাতের অন্ধকারে লুট হলেও ধীরে ধীরে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে চলে আসে লুটের মহোৎসব।
স্থানীয়দের হিসাবে, এ পর্যন্ত অন্তত দেড় কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটির বেশি! একসময় দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা এখন প্রায় পাথরশূন্য; রেলওয়ে বাঙ্কার ভেঙে পড়েছে খানাখন্দে।
আজিজুন্নাহার এ বছরের ১৪ জানুয়ারি ইউএনও হিসেবে যোগ দেন কোম্পানীগঞ্জে। তাঁর দায়িত্ব নেয়ার পর লোক দেখানো অভিযান আরও শিথিল হয়ে যায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলছেন, এ শিথিলতার সুযোগেই লুটপাটকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
তাছাড়া প্রতিদিন পাথর কোয়ারি থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের নামে টাকা উত্তোলন করা হয়। তাজুল ইসলাম মোল্লা নামের একজন এই টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন। পুরো পাথর কোয়ারি এলাকার লোকজন তাকে ‘পরিবেশ মোল্লা’ নামে ডাকে। সেই পরিবেশ অধিদপ্তরের একজনকেও রাখা হয়েছে তদন্ত কমিটিতে।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘লুটে যারা ব্যর্থ, তারাই এখন বিচারক! যাদের নামে অপেন টাকা তোলা হয় প্রতিদিন তারা আসছে তদন্ত করতে। এটা জনগণের সঙ্গে তামাশা ছাড়া কিছুই না।’
১২ আগস্ট জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা) পদ্মাসেন সিংহকে প্রধান করে কোম্পানীগঞ্জ ইউএনও আজিজুন্নাহার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালককে সদস্য করা হয়। তাদের তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা সিলেটের সমন্বয়কারী এডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, ‘যার গাফিলতিতে লুট হলো, তাকেই আবার তদন্তে বসানো জনগণের সঙ্গে তামাশা। জেলা প্রশাসন আসলে চায় না প্রকৃত লুটেরাদের চিহ্নিত করতে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক কাশমীর রেজা বলেন, ‘লুট হয়েছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। যোগসাজশ ছাড়া দিনের পর দিন এমন লুটপাট সম্ভব নয়। এই কমিটি থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না।’
তবে জেলা প্রশাসন বলছে, ইউএনওকে রাখা হয়েছে সাচিবিক দায়িত্ব পালনের জন্য। জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ইউএনওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত আছে, যা তদন্তে সহায়ক হবে। যদি তাঁর গাফিলতি প্রমাণিত হয়, তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মাসেন সিংহও ইউএনওর ভূমিকাকে সমর্থন করে বলেন, ‘তিনি বহু অভিযান করেছেন, সাজা দিয়েছেন। তাঁর উপস্থিতি তদন্তে কাজে দেবে।’
তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, যারা লুট ঠেকাতে ব্যর্থ, তারাই কি লুটেরাদের চিহ্নিত করবে? প্রশাসনের ভেতরকার যোগসাজশ কি কখনো প্রকাশ্যে আসবে? নাকি এই তদন্ত কমিটি কেবল লোক দেখানো নাটকেরই অংশ?
স্থানীয়দের ভাষায়, ‘ব্যর্থদের দিয়ে তদন্ত করানো মানেই সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা।’