https://www.emjanews.com/

8521

sylhet

প্রকাশিত

১৬ আগস্ট ২০২৫ ১৪:২৮

আপডেট

১৬ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৪১

সিলেট

পাথর লুটে প্রভাবশালীদের নাম জানা, অথচ গ্রেফতার নেই

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৫ ১৪:২৮

ছবি: সংগৃহিত।

পাথর লুটের কথা ওঠলেই যাদের নাম আসছে সবার আগে তাদের কাউকেই গ্রেফতার করছে না প্রশাসন। কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় জনগণ, রাজনৈতিক কর্মী, গোয়েন্দাসংস্থা, মিডিয়াকর্মী, পরিবেশকর্মী, প্রশাসন সবাই জানেন এই লুটপাটে জড়িত রয়েছেন প্রভাবশালীরা। মিডিয়াতেও এসেছে তাদের নাম। কিন্তু প্রশাসনের অভিযানে তাদের কেউই ধরা পড়ছেন না।

প্রভাবশালীদের মাঠ পর্যায়ের অনুসারী কজনকে আটক করেই বাহবা কুড়াতে ব্যস্ত রয়েছে প্রশাসন। মিডিয়াও ব্যস্ত প্রশাসনের ‘মহাভারত উদ্ধারের’ সফলতার গল্প প্রচার নিয়ে। লুট ঠেকাতে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা আর বলছে না গণমাধ্যম। ‘অমুকের রান্নাঘর’, ‘তমুকের বৈঠকখানায়’ পাথর পাওয়া গেছে এই নিয়েই গণমাধ্যমে শোরগোল পড়ে গেছে।

পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসন আলাদা আলাদাভাবে সাদাপাথর চোরদের অনুসন্ধান শুরু করেছে। হাইকোর্ট বিভাগও ৭ দিনের মধ্যে চোরের তালিকা দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছেন। 

এদিকে পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় দেড় হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হাবীব। শুক্রবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়েরের পর এ পর্যন্ত ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

আটককৃতরা হলেন- মোহাম্মদ কামাল মিয়া (পিচ্চি কামাল), মোঃ আবু সাঈদ (২১), মোঃ আবুল কালাম (৩২), ইমান আলী (২৮) জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)। এরা প্রভাবশালীদের অধীনস্থ মাঠ পর্যায়ের কর্মী সমর্থক। এর আগের দিন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে আওয়ামীলীগের আমলে দায়ের করা পুরনো এক মামলায় গ্রেফতার করলেও  তাকে পাথর লুটের অভিযোগে আটক করেছে ব্যাপক প্রচার করে। অভিযোগ ওঠেছে ধলাই সেতু রক্ষা কমিটির আহবায়ক হয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তাকে পুরনো মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ।

প্রভাবশালীদের রেখে এসব চুনে পুটিদের গ্রেফতারকে পুলিশের ‘আইওয়াশ’ অভিযান বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সিলেটের এক ভ্রমণ পিয়াসু পুস্তক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘ রুই কাতলাদের’ কেউই গ্রেফতার হননি। অথচ মিডিয়া এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলছে না।  মিডিয়া প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দেখাচ্ছে না।  লোক দেখানো অভিযানকে হাইলাইটস করা নিয়েই ব্যস্ত মিডিয়া।

সাদাপাথর, শাহআরফিন টিলা, রেলওয়ের বাংকার, ধলাই সেতুর নিচের বালুমহাল লুটপাটের প্রধান হিসেবে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ, জেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, আবুল বশর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তেলিখাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আপ্তাব আলী কালা মিয়া, তেলিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, আলফুর চেয়ারম্যানের ভাই আকদ্দস আলী,  কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন,  ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা উত্তর কলাবাড়ির আব্দুল বারির পুত্র সাহাব উদ্দিন, মনির মিয়া (অন্য মামলায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার), হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান জড়িত।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের মদদে প্রকাশ্যে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে পাথর ও বালু লুট করা হতো। প্রশাসন ও মিডিয়াকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই তারা ব্যবসা করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটের সব কটি কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। তাঁদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়।

পাথর লুট চলাকালে স্থানীয় প্রশাসন কিছু কিছু অভিযান চালিয়েছে। সেসব অভিযানে বাধা দেওয়া এবং হামলার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অভিযোগ আছে যে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পাথর লুটপাটকারীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে বিজিবি সদস্যরা আহতও হয়।

সাদাপাথরে পাথর লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন জড়িত। তাঁর অন্তত ১০ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও স্বজন সরাসরি লুটপাটে জড়িত। এ ঘটনায় তাঁর দলীয় পদ স্থগিত করে বিএনপি। বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও স্থানীয় প্রশাসন সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। সাদাপাথর এলাকায় লুটপাটে উপজেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা জড়িত। গত ১৪ জুলাই ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদ থেকে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। 

স্থানীয় বিএনপি ও অন্যান্য সূত্র বলছে, লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, উপজেলা বিএনপির বহিস্কৃত সভাপতি সাহাব উদ্দিনের বোনের জামাই ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন এবং তাঁর ভাই সাজন মিয়া, ছাত্রদলের কর্মী জাকির হোসেন, মোজাফর আলী, বিএনপির অন্তত ১৫ জনের নাম এসেছে।

এদিকে কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণ ধলাই বালুমহাল ইজারা নিয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা ও ধলাই সেতুর নিচ থেকে বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে কয়েক দিন ধরে স্থানীয় মানুষ মানববন্ধন করছেন। ইজারাবহির্ভূত স্থান থেকে নির্বিচার বালু উত্তোলন করায় সেতুর ক্ষতি হচ্ছে। বালুমহালটির ইজারাদার মো. আবদুল্লাহ নাম এক ব্যক্তি। তাঁকে সহায়তা করেন উপজেলার তেলিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু এবং সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ।

এছাড়া সাদাপাথর লুটে জড়িত আছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা ও গণমাধ্যমে যে নামগুলো এসেছে তারা হলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির শওকত আলী বাবুল, শ্রমিক দলের সভাপতি বাদশা মিয়া, সদস্য হাজি কামাল, উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমদ বাহার ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ। ফরহাদ উৎমা পাথর কোয়ারি লুটপাটে জড়িত। এবং আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন। 

জাফলংয়ে পাথর লুটপাটে একজন জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান রয়েছেন। গত বছরের ১৪ অক্টোবর তাঁর দলীয় পদ স্থগিত হয়। নাম রয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত কোষাধ্যক্ষ মো. শাহ আলম ওরফে স্বপন, জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম। লুটপাটের অভিযোগে গত ৯ জুন বহিষ্কৃত, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্সসহ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৩৫ জন নেতা-কর্মীর। 

জাফলং থেকে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বালু ও পাথর তোলায় বিএনপির ৩১ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর গত ২৫ মার্চ একটি মামলাও করেছে।

এদিকে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, সাদাপাথরসহ কোম্পানীগঞ্জে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নাম আসার বিষয়টি তদন্ত করতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় সিলেটে এসেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবাবিষয়ক সহসম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া (জুয়েল) ও সদস্য মামুন হাসান। তারা সম্প্রতি সাদাপাথর এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনের পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন। দ্রুতই তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।

কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশও জানিয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বালু ও পাথর লুটপাটের ঘটনায় ১৯টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬০ জন। এ ছাড়া টাস্কফোর্সের অভিযানে গ্রেপ্তার হন আরও ৫২ জন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, গত বছরের ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের অভিযোগে তারা ১২টি মামলা করেছে। এসব মামলার আসামি ১৯১ জন। গ্রেপ্তার একজন।

সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান প্রভাবশালীদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘সবাই সার্ভিলেন্সের মধ্যে রয়েছে। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

এদেক পরিবেশকর্মীরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো এখন নিজেরা কী কী করেছে, সেটার সাফাই তুলে ধরছে। আসল কথা হলো সমস্ত পাথর লুট হয়ে গেছে এবং তারা তা ঠেকাতে পারেনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট দল বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছে। গত বুধবার বেলা দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল সাদাপাথর সরেজমিনে পরিদর্শন করে দোষীদের শনাক্তের কাজ করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস্ সাদাৎ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, লুটপাটে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী লোক, পাথর-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। এঁদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো নিষ্ক্রিয় ছিল অথবা তারা বাধা দেয়নি।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়েও লুট ঠেকানো যায়নি। এখন সাদাপাথরে যা অবশিষ্ট আছে, সেটা কীভাবে রক্ষা করা যায় এবং পাথর পুনরুদ্ধার করা যায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে।

পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশি কার্যক্রমের ঘাটতির সুযোগে জেলার প্রতিটি কোয়ারিতে পাথর লুট শুরু হয়। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাংকার (রেলওয়ের পুরোনো স্থাপনা) এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন শুরু হয়। এক বছর ধরে লুটপাটের কারণে এসব এলাকা এখন অনেকটাই পাথরহীন।

অন্য সব জায়গায় পাথর বেশির ভাগ লুট করার পর নজর পড়ে পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর এলাকায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে সেখানে লুটপাট শুরু হয়। তবে সেখানে বেশি লুটপাট হয়েছে বিগত এক মাসে।