
ছবি: সংগ্রহ
বালু-পাথরমহালে (কোয়ারি) শ্রমজীবিকায় স্বতন্ত্র ও উদ্ভাবনী এক পেশার নাম ‘বারকি বাওয়া’।
সিলেট অঞ্চলের জলপথে বারকি নামের নৌকায় ভার বহনের প্রচলন প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো।
ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তনকালে ‘জন বারকি’ নামে একজন ব্রিটিশ নৌ-কারিগর বা প্রকৌশলী দলছুট হয়ে ভোলাগঞ্জ এলাকায় আশ্রয় নেন। সেখানকার ধলাই হয়ে সুরমা নদীতে তখনকার চুনাম বাণিজ্যের প্রসারে জলপথে চুন পরিবহন দেখে নিজেই তৈরি করেন একটি নৌকা। হাতে তৈরি হাতে বাওয়ার নৌকাটি জন বারকি তৈরি করেছিলেন বলে এর নাম হয়ে যায় ‘বারকি নাও’। সেই থেকে পাথর ও বালুমহালের আরেক পেশা হয়ে ওঠে ‘বারকি বাও-বারকি নাও’।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ধলাই নদ অববাহিকায় দেশের সর্ববৃহৎ পাথরমহাল ভোলাগঞ্জ। সেখান থেকে প্রথম বারকি বাওয়ার প্রচলন হলেও প্রায় ৩০০ বছরের পথ পরিক্রমায় ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সিলেট অঞ্চলে।
জলপথে জলজীবিকায় বর্ষাকালে ব্যাপকভাবে চলে বারকি। এতে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত থাকেন। বারকি বাওয়ার বাড়তি শ্রমের সঙ্গে জড়িত আরও লক্ষাধিক মানুষ। তবে গত প্রায় চার বছর ধরে পাথরমহাল একটানা বন্ধ থাকায় শত-সহস্র বারকি নৌকা বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে। নিজ গৃহে পরবাসীর মতো বারকি শ্রমিকরা নিজ মহালেই বেহাল দশায় পড়ে পার করছেন সংকটাপন্ন জীবন।
বেহাল দশার কথা ব্যথা ভরা কণ্ঠে জানালেন ভোলাগঞ্জ পাথর মহালের ধলাইনদপাড়ের কলাবাড়ির বাসিন্দা ফয়জুল ইসলাম। তার দাদা মনসুর আলী বারকি কিনে ভাড়ায় খাটাতেন। তার বাবা মো. ওসমান আলী সারা জীবন বারকি বয়েছেন।
বংশ পরম্পরায় বারকিশ্রমিক ফয়জুল বলেন, ‘আমরার এক ধলাইয়ে কম কইরা অইলেও ২০০-৩০০ বছর ধরি বারকি বাওয়া চলে। কোয়ারি (মহাল) বন্ধ, বারকিও না চালাইয়া নষ্ট। আমরার বেহাল দশা দেখার কেউ নাই।’
সায়রাত মহাল ইজারা ব্যবস্থাপনা সূত্রে জানা গেছে, নিরবচ্ছিন্ন বারকি পেশায় প্রথম সংকট দেখা দিয়েছিল করোনা মহামারির সময়। সিলেট অঞ্চলের সবকটি পাথর ও বালুমহালের কার্যক্রম শাটডাউন হওয়ায় তখন বারকি শ্রমিকরা অনেকটা কর্মহীন হয়ে পড়েন। করোনা পরিস্থিতির পর বালুমহাল স্বাভাবিক হলেও পাথর মহাল চালু হয়নি। বারকি শ্রমিকরা কায়িক শ্রমের জন্য অনেকটা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় ছিল।
সম্প্রতি সিলেট জেলা প্রশাসন থেকে পাথর মহাল ইজারা বন্দোবস্তের তোড়জোড়ও শুরু হয়েছিল। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেশের ১৭টি পাথরমহালের ইজারা স্থগিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া, রতনপুর, উৎমা ও শ্রীপুর পাথর মহালও রয়েছে।
গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর, সিলিকাবালু, নুড়িপাথর, সাদামাটি মহালগুলোর ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সভায় পরিবেশ সংকটাপন্ন বিবেচনায় দেশের ৫১টি পাথর মহালের মধ্যে ১৭টির ইজারা দেওয়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পাথরমহাল এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতা ও যন্ত্রচালিত পাথর উত্তোলন বন্ধ করতেই ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
পাথরমহালসংশ্লিষ্টদের মধ্যে সরকারের এ নির্দেশনায় অসন্তোষ বিরাজ করছে। সরাসরি পাথর উত্তোলন ও পরিবহনে জড়িত শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সবার আগে বারকি শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে বলে জানা গেছে।
পাথরমহালগুলোতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বারকি নৌকায় নির্ভরশীল শ্রমিকের সংখ্যা লক্ষাধিক। হাজার হাজার বারকি নৌকা আর লাখো শ্রমিকের রোজগারে ছেদ পড়ে যন্ত্রচালিত নৌযানের প্রচলনে। ‘ড্রেজার’ কিংবা ‘বোমা মেশিন’ নামে যন্ত্র পাথরমহালে প্রবেশ করায় বারকি বাওয়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।
ধলাই নদ ছাড়াও বারকি চলে সিলেটের গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, জাফলংয়ের পিয়াইন নদ, কানাইঘাটের লোভাছড়া, সুনামগঞ্জের চলতি ও জাদুকাটা নদীসহ সিলেট অঞ্চলের হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের জলপথে।
বারকি শ্রমিকরা বলছেন, একটি বারকি নৌকায় অন্তত চারজন শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহ হয়। রোজ ২০০ টাকায় নৌকা ভাড়া নিয়ে তাদের সম্মিলিত রোজগার চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এ হিসাবে একটি বারকি নৌকার মালিক থেকে শ্রমিক পর্যন্ত পাঁচজন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। প্রতি বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে বারকি নৌকার হাট বসে। একেকটি নতুন নৌকা ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়। এ হিসাবে ছয় মাস নৌকা ভাড়া দিয়ে মালিকের পুঁজি উঠে আসে। পরবর্তী বর্ষা মৌসুম থেকে বারকি নৌকা ভাড়া দিয়ে লাভের মুখ সহজে দেখা যায়।
জলপথের ঘোড়াখ্যাত এই বাহনটির পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় পাথরমহালে যন্ত্রের আগ্রাসনে। সকল কাঁটা ধন্য করে কি চলা যায়? বারকি কিন্তু চলছে।
২০০৭ সাল থেকে যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বারকি। কিন্তু দ্রুততম সময়ে পাথর আহরণ ও পরিবহনে যন্ত্রচালিত নৌযানের প্রবেশে পাথরমহালের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি ২০০৮ সালের দিকে পাথরমহালে যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলনে উচ্চ আদালতে একটি রিট করলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এরপর যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে প্রথম দফা ২০১৬ সালে ছয় মাস পাথরমহাল বন্ধ রাখা হয়।
২০২০ সাল থেকে সিলেট অঞ্চলের সব পাথরমহাল বন্ধ হয়ে পড়ে। পরিবেশের ক্ষতির দিকটি বিবেচনায় নিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ রেখে আমদানির ওপর জোর দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে চাহিদা।
এদিকে পাথর আমদানিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ভারততোষণ নীতি দাবি করে পাথরমহাল ইজারা স্থগিতের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাথর ব্যবসায়ী সংগঠন।
২৮ এপ্রিল কোম্পানীগঞ্জের টুকেরবাজারে একটি পার্টি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে অবিলম্বে সিলেটের পাথর মহাল ইজারা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। অন্যথায় বৃহত্তর সিলেটবাসীকে নিয়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
সেই আন্দোলন নামের আগুনে ঘি ঢালার মতো ঘটনা ঘটে ১৪ জুন; দুই উপদেষ্টার জাফলং সফরের পর ভবিষ্যৎ পন্থা অন্ধ হয়ে প্রলয় বন্ধ করার মতো একটি ঘোষণার ফলশ্রুতিতে পাথরসংশ্লিষ্টদের বিষয়ে এখন রাজনৈতিক একাত্মতা ঘটেছে।
তারা সাড়ম্বরে বলছেন, সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা মাফিয়া সিন্ডিকেট ও ভারতীয় এজেন্টদের মদদে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় পাথরমহাল ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
২৮ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন লিখিত ভাষ্য, ‘যুগ যুগ ধরে উজানের পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পাথর সংগ্রহ করেই এ অঞ্চলের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পাথরমহাল চালু থাকা অবস্থায় মানুষের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়। তখন ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা পাথর ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন। লাখ লাখ বারকি শ্রমিক পাথর আহরণ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু পাথর মহাল ইজারা স্থগিতে এখন আকাল পরিস্থিতির মুখে পড়েছে পুরো এলাকা।’
বলছিলাম বারকির কথা। বারকি বাওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবীদের শ্রমজীবিকা সচল থাকে। বেহাল দশা ঘোচাতে পাথরমহাল ইজারা ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন।
তিনি বলেছেন, ‘সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনে টোকেন প্রথার প্রচলন করলে বারকি শ্রমিকদের আর কর্মহারা হয়ে থাকতে হবে না।’
মনে পড়ে ‘বানজারান’ সিনেমার কথা! সেই আশির দশকে হবে হয়তো। রেডিওতে ভেসে আসত ‘হ্যাঁ ভাই! সিলেটের জাফলংয়ে চিত্রায়িত...’।
ইউটিউবে সার্চ দিয়ে সেই ভাষ্য পাই না। তবে সিনেমার কিছু দৃশ্যপট পাওয়া যায়। ‘আমরা তো বানজারান...’ গানটিতে শাবানার নৃত্য ঝংকারের সঙ্গে দেখা যায় পাহাড়-পাথর কেমন ছিল।
‘বানাজারা’ থেকে বানজারান। শব্দের অর্থ যাযাবর। বারকি, বানজারান কি একাকার হয়ে যাচ্ছে? বারকি আগের মতো চলছে না বলে কায়িক শ্রমের বাজারে বেকার বা যাযাবর বারকিশ্রমিক।
বানজারান দিয়ে জাফলংকে দেখা গেলে পাওয়া যায় সেকালের সুনসান পরিবেশ। মাছ ধরার মতো করে বালু-পাথর আহরণ চলছে। জলের তোড়ে চলছে যন্ত্রবিহীন হাজার হাজার বারকি নাও। আর লাখো মানুষের জীবিকা আহরণ ছিল নিঃশব্দ।
নীরবে সেই নিঃশব্দ প্রার্থনাই হচ্ছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের ষোলআনা সুরক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক ও ‘বারকি, জন বারকি’গ্রন্থের লেখক।